গ্রন্থ আলোচনাঃ পথের পাঁচালী


"'পথের পাঁচালী' বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।"- রবি ঠাকুর।

বইটির জোর কতখানি তা না পড়লে অনুধাবন কোনভাবেই সম্ভব নয়। পরবর্তী লাইনগুলো নিছক আমার ধৃষ্টতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা প্রার্থনীয়।
ইছামতীর তীরে নিশ্চিন্দিপুর গাঁ এর ব্রাহ্মণ রায় পরিবারের দরিদ্রতার সংগ্রাম, গ্রামীন সংস্কারের আড়ম্বরতা, বৃটিশদের অধীনে গ্রাম্য সমাজের দশা আবার একইসাথে বড় বাড়িগুলোতে জমকের বলিহার - আর সবকিছু ছাপিয়ে অদৃষ্টের অমোঘতা এবং এরই মাঝে সপ্রতিভ এক বালকের জন্ম হতে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা আর নিষ্ঠুর বাস্তবতার পাঠশালায় হাতেখড়ি নেয়া। প্রকৃতি এ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর উপর কি পরিমান প্রভাব বিস্তার করেছে তা সত্যি বিস্ময়কর। হুমায়ূন কবিরের ভাষায়-

"No other Bengali writer - in prose or poetry - has felt so vividly the intimate relation between man and nature"

**মন্দকারক সতর্কীকরণ**

তিন খন্ডে বিভক্ত ও ৩৬ পরিচ্ছেদে বিস্তৃত উপন্যাসটির 

১/ বল্লালী-বালাই, ৬
২/ আম আঁটির ভেঁপু, ২৪
৩/ অক্রূর সংবাদ। ৬


সম্পর্কে অনেক সমালোচক বলতে চান মাঝের ২৪ পরিচ্ছেদই আসল কিন্তু মূল দৃশ্যপট অংকনের জন্য এবং তিনটি যুগ-স্থান-পাত্র যথাযথভাবে প্রকাশ করবার জন্য ইন্দির ঠাকরুনের পরিণতি, এরপর অপুর সাথে দূর্গার ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা আর ইতিতে গ্রামের পাঠ চুকিয়ে শহুরে নতুন পরিবেশে এক নির্বোধ বালকের উপলব্ধি সবকিছুই এক মালারই যুগপৎ আকর্ষন। বিধবাদের প্রতি অনাচার-অবহেলা, গ্রামের যজমানি প্রথার ক্রূরতা, নিতান্ত সাধারণ ও অল্পদর্শী অভাবগ্রস্তা গৃহবধূর আপাত নিষ্ঠুর আচরন এবং তার ছোট মেয়ের বিশাল মমতার পরিচয় দিয়ে বল্লালী-বালাই পর্ব সূচিত। বল্লাল যুগের কুলীনতার বলি হয় ইন্দির ঠাকরুন। 
সবচেয়ে প্রাণ সঞ্চারী খন্ড আম আঁটির ভেঁপু। এতে তিলে তিলে বড় হয় অপু। আর তার নিষ্পাপ মন ও কৌতূহলী চোখ দিয়ে পাঠক দেখে সমাজের কঠিন কিছু প্রথা, কিছু রঙিন স্বপ্নবিলাসিতা, কিছু আহ্লাদিত অভিমান - সর্বোপরি মানবশিশুর দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত বিশ্ব। নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের আনাচে কানাচে ছুটে ফিরে দুই ভাই বোন আর তাদের বাবা-মায়ের চলে অফুরন্ত জীবন সংগ্রাম। এরই মাঝে তারা স্বপ্ন দেখে, আশাহত হয় আবার নতুন কল্পনার বীজ রোপন করে। মানুষের আসা যাওয়ার মাঝে প্রকৃতিই কেবল নীরব নিঠুর দর্শক হয়ে সবকিছুকে জড়িয়ে রাখে। নগন্য জিনিসের মাহাত্ম্য ও উপযোগিতা ঢের বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। দরিদ্রতার কড়াল গ্রাসে বারবার আহত হয় বামুনদের আত্মমর্যাদা, তবু যুদ্ধ থামে না। ভাল-মন্দ, মমতা-পাষন্ডতায় জড়ানো এক একটি চরিত্র যেন সমাজের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। 
শেষ খন্ডে অপু গ্রাম ছেড়ে শহুরে পথে পা বাড়ায়। নতুনভাবে জগৎকে দেখে। গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে, পরিমল নদীর ধারে-বুকে আর বন বাঁদারের মাঝে সে আত্মাটুকু ফেলে এসে শহুরে ইট-কাঠের খাঁচায় নতুন অর্থ খুঁজে ফেরে। যান্ত্রিকতা ফেলে বাস্তবতার পাঠারম্ভ হয় নিতান্ত সরল, সৎ ও সুকুমার বালকের। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নিত্য চক্রে গড়াতে গড়াতে মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে। আর এরই মাঝে এক সত্য, সুন্দর আর অপরূপ মায়াভরা কথাসাহিত্য এটি।
মৃত্যু আকীর্ন উপন্যাস পথের পাঁচালী। প্রধান ৫ চরিত্রের ৩ টিই কালে-অকালে ঝরে পড়ে। প্রতিটি মৃত্যুই করুন রসে সিক্ত। লেখকের নিষ্ঠুর মনোবৃত্তি এক্ষেত্রে প্রকৃতি থেকে কোনরূপ কম নয়। চরিত্রগুলোকে নিবিড় মায়ায় গড়েছেন বিভূতিভূষণ ব্যানার্জি। অসহায়ত্ব, কুটিলতা, অকৃত্রিম সরলতা, ক্ষুদ্র হতে বৃহৎ কপটতা, অণু করুণা, সীমাহীন দরদ আবার কঠোর হৃদয়হীনতা, কখনো সৃষ্টিছাড়া উল্লাস, কোথাও আবেগী সম্প্রকাশ। বিভূতি বাবু নিভৃতিতেই এক অসামান্য রত্ন দিয়ে গেছেন বাংলা পাঠকদের৷ এ রস আস্বাদনে ব্যর্থ বাঙালিদের জন্য আফসোস ছাড়া কিছু বরাদ্দ রাখা চলে না।
পুরো উপন্যাস জুড়ে যে প্রকৃতিঘেঁষা আকুতি আর চরিত্রগুলোর অসামান্য মেলবন্ধন তা বোধ হয় নিরবিচ্ছিন্নভাবে কেবল বিভূতিভূষণ ব্যানার্জিই সার্থকভাবে উদ্ধৃত করতে পেরেছেন। William Wordsworth বা Thomas Hardy এর সাথে অনেক সময় সার্থকভাবে তুলনীয় তাঁর নিসর্গপ্রিয়তা। কাব্যময়তা নেই, আছে অদ্ভুত ছন্দময়তা। ভাষার চমক নেই, আছে সাধারণের মাঝে অসাধারণের প্রকাশ। 
আর আছে এক গভীর জীবনবোধ। পথের দেবতার অনিবার্য অভয়বাণী। 
'সামনে এগিয়ে যেতে হবে।'
অপুর নরম মন যখন আর্দ্র হয় পাঠক অনুভব করে কিছু দীর্ঘ কালের উপলব্ধি। চরিত্রের মৃত্যুতে পাঠক হয় হতচকিত আবার কোথাও অশ্রুসিক্ত। এইই তো উপন্যাসের মায়া। এইই হয়তো দরদ।

"একশত বৎসর একসংগে থাকিলেও কেহ হয়তো আমার হৃদয়ের বাহিরে থাকিয়া যায় যদি না কোন বিশেষ ঘটনায় সে আমার হৃদয়ের কবাট খুলিতে পারে।" 
"করুনা (দরদ) ভালবাসার সবচেয়ে মূল্যবান মশলা, তার গাঁথুনি বড় পাকা হয়।"

এ কাহিনীতে আছে একইসাথে জীবনের নিষ্ঠুরতা আবার একই সাথে আছে অপরাজিত এক স্পৃহা- সব জয় করবার, সব কিছু ছাপিয়ে অনুভবের জয়গান গাইবার। এ শক্তি, এ দুর্বার সরলতা উপেক্ষা করে যাওয়াটা নিতান্তই অমার্জনীয়।পূর্বেই বলেছি, এ সৃষ্টির মূল্যায়ন করতে চাওয়া ধৃষ্টতা বৈ বেশি কিছু নয়, তথাপি এহেন অমূল্য রস আস্বাদনের পরে কিছু বাক্যব্যয় না করলেও চলে না যে!

Comments

  1. পথের পাঁচালী পড়ার আগেই অধিকাংশ পাঠক/পাঠিকা সত্যজিৎ রায় নির্মিত সিনেমাটা দেখে থাকেন। এটা ঠিক যে উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ যে দৃশ্যায়ন করেছেন এবং গল্প বুনেছেন তার একটা ধরণ আছে। তবে বই পড়লে যে ধরণের কল্পনার অভিজ্ঞতা হয় সেটা সিনেমা দেখলে একটা নির্দিষ্ট ইমেজের মধ্যে, দৃশ্যের মধ্যে ধরা পড়ে বলে বই পড়া আর সিনেমা দেখা আলাদা ব্যাপারে দাঁড়ায়। সাধারণত মানুষ তার পরিমন্ডল বা দেখা পরিবেশ থেকে ইমেজ আর চরিত্র কল্পনা করে থাকে। পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গার কাশবনের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখার দৃশ্যটা না দেখলে পাঠক/পাঠিকা তার মনের গভীরে কোন কাশবনের দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করে থাকতে পারেন বা যদি কাশবন দেখার কোন স্মৃতি না থাকে তবে হয়ত দেখতে বের হতে পারেন বা এখনকার যুগে অন্তর্জালে খুঁজতে পারেন। আর যারা আগে পড়ে থাকেন তারা পড়ার সময় যে গাছপালার বর্ণনা পান সেটা সিনেমায় নাম ধরে দেখানো যায় না তাই বই পড়া অন্য এক দৃশ্যপট সৃষ্টি করে। মূল ঘটনাপ্রবাহ দেখানোর জন্য জীবন এবং জীবন্তকে বইয়ের অনুরূপ দেখাবার ক্ষেত্রে পথের পাঁচালী পড়ায় ও দেখায় দুইটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয় বলে উপন্যাস ও সিনেমা দুই ক্ষেত্রেই চলেছে। এমন যে সমস্ত গল্পগুলো সাহিত্যে লেখা হয় এবং তা নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা হয় প্রত্যেকটাই পড়া আর দেখার মধ্যে একটা আলাদা অভিজ্ঞতা ও অবস্থান সৃষ্টি করে থাকে। যেমন হ্যারি পটার মুভি পড়ার আগে দেখার ফলে পড়তে গিয়ে পর্দার হ্যারিকে ভেবেই পড়ে ফেলেছি এবং তার জন্য বেশি বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ধরুন কেউ একজন কোন সিনেমা না দেখে শুধু পড়ে থাকলে তার কল্পনায় হ্যারির অবয়ব, অন্যান্য চরিত্র ও এই গল্পের জগতের ধারণা প্রত্যেক মানুষের আলাদা হবার কথা। আর আলাদা মানুষের কল্পনার ধারণা জানতে পারলে জানা যাবে একই গল্পের কল্পনা ও দৃশ্যের বিসাদৃশ্য কেমন হয়। সিনেমার গল্প, দৃশ্য ও চরিত্রে তাই পাঠক/পাঠিকা তার নিজস্ব কল্পনার বদলে সৃষ্ট দৃশ্য দেখার একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. যথার্থই বলেছেন। চিত্রকল্পে দর্শকের চিন্তাশক্তির প্রসারণের সুযোগ একটু কম থাকে। সেক্ষেত্রে পরিচালক ও চিত্রগ্রাহকের মুন্সিয়ানা আমাদেরকে বঞ্চিত করবে কিনা - তার জন্য নির্ভর করতে হয়। বই পড়ে কিন্তু সেটার ব্যাপার নেই। চাইলে একটি হিজল গাছের কল্পনায় পাঠক/পাঠিকা ২০ গজি গাছ মনে করে নিতেই পারে। খড়ের চালের স্তরবিন্যাসে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা কল্পনা করার পূর্ণ স্বাধীনতাটা কিন্তু পাঠকেরা পায়।
      আর এখানেই দুই শিল্পের সৌন্দর্য।
      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!

      Delete

Post a Comment