গ্রন্থ আলোচনাঃ গোরা
গোরার প্রচ্ছদ |
রবীন্দ্রনাথ কোন মহাকাব্য লিখেননি সত্য। কিন্তু এইখানাকে টেপেটুপে গদ্যের মহাকাব্য বলে চালানো যেতেই পারে। বিশাল কলেবর। তার উপর বেশ কিছু চরিত্রের মানসিক, পারস্পরিক আর সামাজিক-নৈতিক দ্বন্দ্ব, পরিণতি আর তার সাথে সাথে সমগ্র ভারতবর্ষের সম্পর্কে বেশ কিছু দার্শনিক ভাবনা, কিছু আত্মোপলব্ধি - এ সবে মিলিয়ে মহাকাব্যিক বিস্তৃতি বৈকি! সুদীর্ঘ আড়াই বছর ধরে লেখা এই উপন্যাস (১৯০৭-১৯০৯)। তাছাড়া সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কেই বা এমন শক্ত সুরে 'জাতীয়তাবাদ'এর গান গাইবার সখ করেছিল।
লেখার সময়টাও বেশ গুরুত্ববহ। বঙ্গভঙ্গ সবে কার্যকর হল। কবি রবি তার মোটেও পক্ষে ছিলেন না। সমগ্র উপন্যাসজুড়ে সেই নিয়মাবদ্ধ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচারের সুর। শাসন-আইনকে তুচ্ছ করে সামগ্রিকতার বিচারে মানুষ আর মনুষ্যত্বের জয়গানই পুরো উপন্যাসের মূল তাল, মূল লয়। পাশাপাশি ধর্ম-সমাজ-রাজনীতি নিয়ে সাধারণের বৃথা আস্ফালন, নৈতিকতা-বিবেক-বুদ্ধি বিবর্জিত কিছু আচরনের তীব্র সমালোচনা ও ক্ষেত্রবিশেষে কটাক্ষ করতেও রবি পিছপা হননি। ১৮৮০ এর দশকে ও তার পরবর্তী সময়ে সমাজব্যবস্থার বিবর্তন ঘটতে থাকে। একে তো ইউরোপীয় খ্রিস্টান সমাজের আচার-বিচার ভারতে বেশ প্রভাব বিস্তার করে দুইভাবেঃ চাটুকারদের আরাধ্য মানদন্ড এবং আচারসিদ্ধ ও গোঁড়াদের তীব্র ঘৃণার ক্ষেত্র হিসেবে। তাছাড়া রামমোহন ও দেবেন ঠাকুরের ব্রাহ্ম ধর্মও কলকাতায় বেশ প্রভাব বেশ বিস্তার করে। হিন্দুরা তাদেরকে যেমন সমাজচ্যুত ভাবতে থাকে। ব্রাহ্মরাও তার থেকে এক কদম পিছিয়ে ছিল না। মুসলিমদের তখনো গণনার বাইরেই রাখা হত প্রায়। এহেন ধর্ম ও সমাজ নিয়ে কাদা ছোড়াছোড়ির মাঝে কিছু 'আদর্শ রাবীন্দ্রিক চরিত্র' এর অবতাড়না এবং তাঁদের মধ্য দিয়ে এসব ঘাত-প্রতিঘাতের সাহিত্যিক উপস্থাপনার প্রয়াস রবি ঠাকুরের।
"আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব তোমার সত্য-তোমার ধর্ম-কেবল তোমার কিংবা আর দু-চার জনের বাক্য বা মত নয়; সে চারিদিকের সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের সূত্রে জড়িত-তাকে ইচ্ছা করলেই বন থেকে উপড়ে নিয়ে টবের মধ্যে পোঁতা যায় না..."এ বানী যে কি শক্ত, কি গভীর এর অনুধাবন-তা পাঠকমাত্রেরই আগ্রহ জাগানো ও শিহরণ বইয়ে দিতে সক্ষম।
**মন্দকারক সতর্কীকরণ**
উপন্যাসটি গহীন মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা, চরিত্রদের বাদানুবাদে গূঢ় দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক তত্ত্ব-বিচার বিশ্লেষণে ভারাক্রান্ত মনে হলেও উপভোগ্য। প্রধান ও নামীয় চরিত্রের আত্মোপলব্ধিই এই ঘটনাপ্রবাহের মূল উপজীব্য বলাই যায়।
গোরা ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রতিপালিত আইরিশ বংশোদ্ভূত বলিষ্ঠ পুরুষ। তার জন্মপরিচয় তার জানা নেই। ফলে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে সে বহুকাল গোঁড়ামি করে হিন্দু রীতি-নীতি প্রচারে প্রসারে ব্রত হয়। তার লড়াই হিন্দুত্বের ঐতিহ্য রক্ষার্থে। কোন বিভাজন- সে ধর্ম ধরে হোক কি সমাজ ধরে হোক - তা তার কাছে অগ্রহনযোগ্য। সে নীতিবান, সত্যবাদী ও দার্শনিক। তার কাছে সমগ্র ভারত একটি সত্ত্বা। তার যাত্রা হিন্দুত্ববাদ রক্ষার্থে শুরু হলেও বহু কাহিনী, ধারা-উপধারা, শাস্তি, অনুধাবন ও রহস্যোদ্ঘাটনের শেষে তার বোধোদয় হয়। মনুষ্য ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ বলে সে ঘোষণা করে। গুরু মেনে নেয় উপন্যাসের সৌম্যতম চরিত্র পরেশবাবুকে আর ভারতত্বের মাতা রূপে প্রণাম করে মা আনন্দময়ীকে। আর এই গোরাকে দিয়ে গীত হয় আধুনিক যুগের জাতীয়তাবাদের উদারপন্থী গান। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ভেদ করে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে মনুষ্যত্বের আবেগী অঙ্কুর।
ধর্মীয় সহনশীলতা আর মানবধর্মের মহান মধ্যমপন্থা প্রচারকারী দুটি চরিত্র এই পরেশবাবু ও আনন্দময়ী। তাঁদেরকে দিয়ে রবি ঠাকুর বলিয়েছেন যাবতীয় অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতার মহৎ বানী। আর গাইয়েছেন সাম্যের গান। পরেশবাবু দেবেন ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কেশববাবুর মতাদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দিয়েই ঠাকুর সমগ্র উপন্যাসের অভিভাবকের হাল ধরিয়েছেন। বলা বাহুল্য, দেবেন ঠাকুর হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর কেশব সেন মূলত বর্ণপ্রথা বিলুপ্তির প্রশ্নেই ব্রাহ্মসমাজ থেকে পৃথক হন ও তার চেষ্টাতেই ১৮৭২ সালে সিভিল বিবাহ আইন পাস হয় যাতে নারীপুরুষের বিবাহের ন্যূনতম বয়স বেঁধে দেয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথের গল্পের একটি মূল বৈশিষ্ট্য চরিত্রের পোশাক ও সাজ সজ্জা বর্ননা হলেও বিনয় চরিত্রের ক্ষেত্রে তা অস্বাভাবিক ভাবেই কম। যেন কবি বিনয়ের চোখ দিয়ে সমগ্রটা দেখেছেন। বিনয়কে দিয়ে ঠাকুরের মূলত বিদ্রোহ ও সংশয়বাদিতা প্রকাশ পেয়েছে। কাহিনীর প্রারম্ভের নারী চরিত্র সূচরিতার প্রতি আবেগী মনোভাব নিয়েও সায়াহ্নে পৌঁছে অন্য একজনের জন্য বিগলিত হওয়া। ধর্মের টানাপোড়েনে ব্যতিব্যস্ত থেকে শেষে নিরাসক্ততাকে বরণ করে নেয়া - এসবের পাশাপাশি চরমভাবে উগ্রপন্থী গোরার ছায়াপাশে থেকে তাঁকে অগ্রাহ্য করার অক্ষমতা এ চরিত্রকে করেছে আটপৌড়ে এবং সাধারণ। আর এখানেই ঠাকুরের সার্থকতা।
সূচরিতা বা রাধারানী গোরার আদর্শ সঙ্গী। ভাবে, প্রাণে, বুদ্ধিতে ও আদর্শে। তেজদীপ্ত পদচারণা, দৃপ্ত বুলি, অপরাজেয় সম্মানবোধ, মানুষ ও সমাজের প্রতি সীমাহীন দরদ - এসকলে মিলে সে গোরার পরিপূরক। অসামান্য চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যঞ্জনা রাধারানীর মূল আকর্ষণ। নারী হয়েও সেরকম সমাজে ললিতাকে নিয়ে সে কর্মদ্যোগে যোগ দেয়। সমাজচ্যুত হবার ভয়কে মাড়িয়ে সে হয়ে উঠে আত্মনির্ভরশীল ও প্রকৃত লড়াকু সেনা।
এছাড়া বরদাসুন্দরী, হারানবাবু, হরিমোহিনী, কৃষ্ণদয়াল - এরা মোটাদাগে রক্ষণশীল সমাজের সাধারণ সদস্য ও সুতীক্ষ্ণ অনুসারী।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবীন্দ্র পুরো উপন্যাসজুড়ে বিভিন্ন মতাদর্শীদের নানা ভাবে নানা পরিস্থিতিতে দেখা করিয়ে দিয়ে দার্শনিক দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছেন। এরপর তত্ত্ব-তর্ক মিলিয়ে উত্তর-প্রত্যুত্তরের জালে ফেলে খুব ধীরে ধীরে লক্ষ্য করেছেন আলোচনার গতিপ্রকৃতিকে। তাই বিনয়-সুচরিতা, বিনয়-গোরা, বিনয়-পরেশ, গোরা-বরদা, গোরা-হারানঃ এদের আলোচনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে খটমটে দর্শনতত্ত্বের ফুলঝুড়ি। আর প্রণয়াবিষ্ট চরিত্রগুলোর বাদানুবাদ হয়েছে অনুভবের, অনুগ্রহনের। উপন্যাসে সে সুযোগ অনেক কম হলেও কিয়ৎক্ষনের সে ঝলকানি রবীন্দ্রনাথের স্বভাবসুলভ রোমান্টিক আবেশে বর্নীল।
পুরো উপন্যাসটা যাকে ঘিরে তাঁর শেষ পর্যন্ত বিশ্বমানবিকতার সাথে একীভূত হওয়া আর সমাজে প্রচলিত যাবতীয় ধর্ম-বিভেদের সূত্র উপেক্ষা করে এক মানুষের তরে আত্মোৎসর্গ করাকেই বিধেয় ধরে সমাপ্তি টানাটা যথার্থ তো বটেই। তার সাথে আত্মতুষ্টির সঞ্চারক।
এহেন মহান সৃষ্টির কিছু পরশ পেয়েছি বলেই এই ক্ষুদ্র বাক্যব্যয়, অযথা বানী কপচানো। এই উপন্যাসের আবহ মোটেও ক্ষণজন্মা নয়। এখনো তা প্রাসঙ্গিক, এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে সাযুজ্যপূর্ন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেন,
"এ বিশাল সৃষ্টির পর রবির বাকি সৃষ্টি অনেক বেশি খর্ব দেখায়, বেশি অপূর্ণ লাগে।"গোরার বিশালত্বের এই এক কালিমা।
Comments
Post a Comment