ফিচারঃ কালিদাসের মেঘদূত ও তৎসংশ্লিষ্ট (অতি সামান্য) চিত্রকলা


"প্রাচীন সাহিত্য একটি বৃহদায়তন স্থাবর সম্পত্তি নয়, যুগে-যুগে তা বাণিজ্যের যোগ্য বলেই আমরা তাকে 'ক্লাসিক' নাম দিয়েছি।" 
- বুদ্ধদেব বসু 
হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে সৈয়দ মুজতবা আলী, নিমাই ভট্টাচার্যসহ আরো অনেক আধুনিক রোমান্টিক ঘরানার লেখক নারীরূপ বর্ণনায় একটি সংস্কৃত ছত্র হরহামেশা ব্যবহার করেছেন বলে দেখে এসেছি। 'তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা'। মানে, হালকা গড়নের ঈষৎ শ্যামলা তরুণী যার দাঁত সরু-সুগঠিত। এর উৎস হল মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্য 'মেঘদূত'। আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক নেহায়েৎ কম নয়। সংস্কৃত নিয়ে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আস্ত একটি রচনা কখনো পড়া হয়ে উঠে নি। তাই বাংলার আদিরূপ সম্পর্কে  জানতে তুলে নিয়েছিলাম সংস্কৃত কাব্যের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ मेघदूतम বা মেঘুদূত্‌ম বা মেঘদূত বা The Cloud Messenger (বুদ্ধদেব বসুর মতে)। চেষ্টা বিফল হয়নি। কারণ বিফল হলে পরবর্তী অহেতুক বাক্যব্যয়গুলো করতাম না।


Meghdoot 1: Ram Gopal Vijaivargiya (Rajasthani Painter)
Source: 
Moomal Darshna


সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা। ওতে আর কিছু চলে না। তাই তাতে রচিত কোন গ্রন্থই আর পাঠ ও মর্মোদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা রাখে না। একথা অনেকে বলতেই পারে। কিন্তু এখানে আমার একটা কথা আছে। যাতে মনে হয় ভাষা ও মানুষ নিয়ে গবেষণা করে এমন সকল ব্যক্তিই একমত হবেন। ভাষা হল মানুষের কথা। আর ভাষাতেই মূলত মানুষের কথা শোনা যায়। অর্থাৎ যে সময়ের বা এলাকার ভাষা - সেই ভাষা সেই সময়ের, সেই এলাকার কথা বলে। মানুষ জানতে হলে ভাষা জানো। কীভাবে বিশেষণের ব্যবহার হচ্ছে, কীভাবে ক্রিয়ার খেলা হচ্ছে, কী দিয়ে সম্বোধন হচ্ছে, প্রশ্ন, অনুরোধ, অনুজ্ঞায় ভাষাকে কীভাবে বদলে নেয়া হচ্ছে বা সাহিত্যে কিরূপ উপমা, তুলনা নিয়ে সূক্ষ্ম নাড়াচাড়া হচ্ছে - এসব থেকে সেই সময়ের বা এলাকার মানুষের চিন্তা, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, আচার, আচরণ, শিষ্টতাসহ বহু কিছু জানা যায়। আর তার উপর বাংলা ভাষা এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকেই। এখানেই শেষ নয়। আরো যদি বলা যায়, যেমন আমরা সাধারণ পাঠকরা বা দর্শকরা ফ্রেঞ্চ বা রুশ বা জার্মান বা স্প্যানিশ সাহিত্য পড়ে থাকি অথবা চলচ্চিত্র দেখে থাকি। আমাদের সবাই যে সেই ভাষা শিখে ফেলার উদ্দেশ্যে তা করি বা অদূর ভবিষ্যতে এই ভাষার জ্ঞান মহৎ কোন কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে করি তা কিন্তু না। বরং মহান সৃষ্টি বা শিল্প কোন নির্দিষ্ট ভাষা বা এলাকার হতে পারে না। তা সর্বজনীন। তাই ভাষা বিচার না করে সাহিত্যের শিল্পগুণ দেখেই পাঠ জরুরি বলে আমি মনে করি। যাই হোক, এসব গবেষকের কাজ। আমি নিতান্ত পাঠক। কবিতা পড়ে ভালো লেগেছে বলে কিছু লিখার জন্য আঙ্গুলে শান দিচ্ছি। অত কপচানো বাদ দিয়ে আসল কথা পাড়ি।

মেঘদূত নিয়ে প্রথম কথাই শোনা যায় যে এই কবিতা অশ্লীল। নারীকে কেবল ও কেবলমাত্র দেহের অধিকারী হিসেবে দেখা হয়েছে। কথাটা আংশিক সত্য, আংশিক মিথ্যা। গুপ্ত ও মৌর্য যুগে যেহেন পুরুষতান্ত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায় অন্যান্য লেখক (অর্থশাস্ত্র - কোটিল্য, কামসূত্র - বাৎস্যায়ন), নাট্যকার (মৃচ্ছকটিক - শূদ্রক), কবির (রামায়ণ, মহাভারত) বা পুরাণ লেখকদের লেখনীতে - বলছি না কালিদাস তাঁদেরকে ছেড়ে সেই সময়েই অনেকখানি প্রগতিবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশ অনেকটাই মানবিকতা নিয়ে এসেছিলেন। তার ছোট্ট একটি প্রমাণ হল, যখন নায়িকা আমাদের সামনে আসে তখন কবি তাঁর জন্য ১৫টি শ্লোক (চার লাইনে এক শ্লোক) ব্যয় করেন। তাঁর মাত্র একটি শ্লোক নায়িকার দেহবর্ণনায় এবং সেটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। বাকিগুলোতে বিরহত্রস্ত অবস্থা ব্যাখ্যা করতে আবেগ ঢেলে দিয়েছেন কালিদাস। এই ১৪টির মধ্যে যে দেহপ্রসঙ্গ আসে নি, তা ঠিক নয়। তবুও ঢালাওভাবে একথা বলা যাবে না যে, নারীকে কেবল দেহসর্বস্ব হিসেবে দেখেছেন কালিদাস। এছাড়াও আরো বহু স্থানে বিশেষত নদীর বর্ণনায় ললনাদেহ বহুবার এসেছে। সেটাকে ঠিক যৌনতা না বলে সৌন্দর্য ব্যাখ্যার একটি চিরাচরিত উপায় হিসেবে ধরে নেয়াই শ্রেয়। তবে মেঘদূত থেকে এটা বোঝা যায় যে তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থা কি ছিল। বহু ছত্রে শ্লোকে সেটার প্রকাশ রাশি রাশি। এ নিয়ে বিস্তারিত আছে পরবর্তী লেখায় ও বুদ্ধবাবুর প্রবন্ধে।

চরিত্র মাত্র তিনজন। যক্ষ, যক্ষপ্রিয়া এবং মেঘ। যক্ষ উপদেবতাবিশেষ যারা ধন-সম্পত্তির দেবতা কুবেরের সেবায় নিযুক্ত।  তাদের নিবাস অলকা নামক কাল্পনিক এক স্বর্গপুরীতে। আর মেঘটি পুষ্করাবর্ত জাতের, মানে যার থেকে বৃষ্টি হয়। মেঘটি আষাঢ় মাসে রামগিরি (যক্ষের নির্বাসনের জায়গা) দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডেকে যক্ষ একটি বার্তা অলকায় পৌঁছে দিতে বলে যক্ষের প্রিয়ার কাছে।

এখন আসি কাহিনীতে। কাহিনীটা এক লাইনে বলে দেয়া যায় এবং যা অনেকেই ইতোমধ্যে জানেও। তা হলঃ "এক নির্বাসিত প্রেমিক, যক্ষ মেঘকে দিকনির্দেশনা নিয়ে তাঁর প্রেমিকার কাছে একটি বার্তা নিয়ে যেতে পাঠাচ্ছে যা হলঃ 'আমি ভালো আছি। দুঃখ করো না। আর কিছুদিন পরেই ফিরে আসছি'"। ব্যস্‌। এতটুকুই। কিন্তু এটুকু শৈল্পিক কায়দায় বোঝানোর জন্য যে প্রয়াস কালিদাস ঢেলে দিয়েছে, তা অতুলনীয়। ভাষা সুষমা নিয়ে বেশি কিছু বলার যোগ্যতা রাখি না। কারণ, আমি সংস্কৃতে অত পারদর্শী না যে ভাষার ব্যবহার নিয়ে বলবো। তবে উপমার প্রয়োগ নিয়ে কোন কথাই চলে না। যদিও বুদ্ধদেব বসু বারবার বলেছেন, সংস্কৃতে উপমার প্রয়োগ বাঁধাধরা এবং এত নিয়ম-কানুনের মাঝে কালিদাস খুব বেশি বাইরে যাননি। কিন্তু যতবার কোন সংস্কৃত রূপক সামনে হয়েছে বা নিত্য নতুন রূপক কল্পিত হয়েছে ততবারই চমৎকৃত হয়েছি।  আর কালিদাসের কবিত্বে মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছি। সেই সময়কার কল্পনা শক্তির বিস্তৃতি অনেক দূর প্রসারিত ছিল। রচনার পরবর্তী অংশে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখবো।

১১৮ টি শ্লোক নিয়ে এ কাব্যের বিস্তার। প্রতি শ্লোকে ৪টি করে পঙক্তি। শ্লোক ১ হতে ৬৪ পূর্বমেঘ। ৬৫ থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তরমেঘ। পূর্বমেঘে আমরা পাই পথের বর্ণনা আর উত্তরে পাই যক্ষপুরী, যক্ষপ্রিয়া আর তাঁর পাঠানো বার্তা।

পূর্বমেঘ

কাব্যের শুরু যক্ষের পরিচয় দিয়ে। যক্ষ কুবেরের একান্ত সেবক ছিল অলকাতে। তাঁর কর্তব্যের অবহেলার কারণে কুবের তাঁর দৈব ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে এক বছরের নির্বাসনে পাঠায় রামগিরিতে। বেচারা ছিল কুবেরের বাগান রক্ষক। একদিন তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে ঐরাবত ঢুকে কুবেরের বাগান নষ্ট করে। ফলে এই শাস্তি।

কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাপ্রমত্তঃ
                    শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ    (শ্লোকঃ ০১)

আট মাস কেটে গেল। আষাঢ়ের প্রথম দিনে তাঁর প্রাণ আকুলি-বিকুলি করে উঠল। বর্ষার আগমনের জানান দিয়ে মেঘ তাঁর দিকে উড়ে আসতে থাকে। এ থেকে যক্ষের রতিচিন্তার উদ্রেক হয়। কেননা বর্ষাকাল আবহমান কাল থেকেই ভারতীয় নর-নারীর প্রেম ও বিরহের কাল। প্রবাসী পতিদের বাড়িতে ফেরা না ফেরার উপর নির্ভর করতো ঘরপত্নীদের এক ঋতুকাল মচ্ছব নাকি বিরহ। বর্ষা সেই যুগে বানিজ্যহীন ঋতু ছিল। পতিরা এলে বর্ষার আগে আসতো নয়তো আরেক বছর তাদের পত্নীরা অপেক্ষায় থাকতো। তাই তাঁর প্রিয়ার বিরহের কথা চিন্তা করে যক্ষ মেঘকে দিয়ে বার্তা পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাই সে গিরিমল্লিকা (কুড়চি) ফুলের অর্ঘ্য দিয়ে মেঘকে আহ্বান জানায় তাঁর একটি আবদার রাখতে। প্রথমে যক্ষ মুখ খুলে চাটুবাক্য দিয়ে,

জাতং বংশে ভুবনবিদিতে পুশকরাবর্তকানাং
                        জানামি ত্বাং প্রকৃতিপুরুষং কামরূপং মঘোনঃ    (শ্লোকঃ ০৬)

এরপর যক্ষ মেঘকে গন্তব্যস্থল বলে দিল। অলকা। যক্ষপুরী সেখানে। কাল্পনিক এক স্বর্গনগর সেটা। সেখানে তাঁর গৃহে প্রিয়া অপেক্ষমান।
এরপর শ্লোক ০৮ হতে ১২ পর্যন্ত যক্ষ বর্ণনা করে কেন মেঘ যাবে। এতে মেঘের লাভ কোথায়। যাবার পথে বহু তরুণীর আদরমাখা দৃষ্টি সে পাবে। পাবে চাতকের মধুঝরা সঙ্গীত, সাথে বকপালের সেবা তো আছেই। তাছাড়া পুরো পথ তাঁর একা যেতে হবে না কারণ তাঁকে সঙ্গ দেবে রাজহংসের পাল। শিলীন্ধ্র (ব্যাঙের ছাতা) পথে পথে জাগিয়ে যখন মেঘ যাবে সেই দৃশ্য সহজে ভোলার মতো নয়। ভূভারতের সৌন্দর্য অবলোকন করার এ মহৎ আবেদন মেঘের সহজে মানা করার কথা না।
আর যেহেতু মেঘকে উত্তর দিকে যেতে হবে, পথে ক্লান্তি যাতে না ধরে তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে পথেই। পৃথিবীর স্তনরূপ পাহাড়গুলোর মাথায় অনায়াসে গা এলিয়ে দিয়ে মেঘ বিশ্রাম নিতে পারবে। আর আছে প্রচুর নির্মল পানিবাহী নদী ও হ্রদ। যা থেকে মেঘ তার তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতে পারবে।

এরপর শ্লোক ১৬ থেকে ৬৪ পর্যন্ত মেঘের পথের বর্ণনা দিয়ে যায়। আর এখানেই ছন্দময়তা, কালিদাসের ভূগোল জ্ঞান, প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ নয়ে সুচারু ধারণার নিপুণ সমাবেশ পাই আমরা। কি উপমার খেলা, কি শব্দচয়নে মুন্সিয়ানা! পূর্বমেঘের মূল আকর্ষণ এখানে।

প্রথমেই কৃষিপ্রধাণ ভূভারতে মেঘের অবদান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তাঁকে হালকা হয়ে নিতে বলে যক্ষ বৃষ্টি ঝরিয়ে। এতে গ্রামের বধূরা তাঁর প্রতি থাকবে কৃতজ্ঞ। এরপরে তাঁর চোখে পড়বে আমবাগানের শ্যামলিমা। সেটা পার হয়ে গেলে তাঁর সামনে আসবে পাহাড়। সেই পাহাড়ে পাকা ফলের সম্ভার দেখে মেঘ অবাক হয়ে যাবে। ঝরিয়ে দেয়া বৃষ্টিতে যাতে মেঘ হতাশ না হয় সে জন্য যক্ষ তাঁকে রেবা (নর্মদা) নদী হতে সুগন্ধি পানি পান করে নিতে বলে। পুষ্টিসাধন শেষে মেঘ আরো উত্তরে আগালে হাতির পালের সাথে দেখা হবে যারা বংশবৃদ্ধির জন্য উন্মুখ হয়ে আছে বর্ষার কারণে।
এরপর একে একে তাঁর চোখে ধরা পড়বে ভুঁইচাপা জলার ধারে পানরত সারঙ্গ বা হরিণের দল, বর্ষার গান গাইতে থাকা চাতকদল, আর কিছুদূর সঙ্গী হবে কেকারবে মুখর ময়ূরের পাল। সেসময় ঐ এলাকার কেয়া ফুলের বাগান ভরে উঠবে সৌরভে আর গ্রামের সকল কাক-শালিকেরা মেঘের আগমনে হয়ে উঠবে চঞ্চল। বনের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়বে প্রচুর পাকা ফলের রঙ।

 পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ সুচিভিন্নৈঃ-
               নীড়ারম্ভৈর্গৃহবলিভুজামাকুল্গ্রামচৈত্যাঃ।    (শ্লোক ২৪)

বিদিশায় এসে পৌঁছুলে মেঘ পাবে শৃঙ্গারবৃত্তির পূর্ণফল। কারণ তার পাশে বেত্রবতী বা বেতোয়া নদীর কলতানে, তার ঢেউয়ে, বাঁকে বাঁকে মেঘ পাবে নারীর অপরূপ ভ্রূভঙ্গিমা । এসব পেছেনে রেখে এগিয়ে গেলে যে পাহাড় পড়বে তাতে মেঘের ছোঁয়া পড়তেই জেগে উঠবে কদমের কুঁড়ি। আর নারীদের গায়ে আড়মোড়া ভাঙবে যৌবনের আহূতি। সে পাহাড়ে যে মালিনীরা ফুল তুলতে ব্যস্ত তাদেরকে যাতে জল ছিটিয়ে দেয় মেঘ সে আহ্বান করে যক্ষ। কারণ তারা পুষ্পশ্রমিক। মেঘের বর্ষণে ও ছায়ায় তারা ক্ষণিকের আনন্দ ও মুক্তি পাবে।
এই পাহাড় পেরিয়ে এলে মেঘ পৌঁছবে উজ্জয়িনীতে। যেখানেঃ

বিদ্যুদ্দামস্ফুরিতচকিতৈস্তত্র পৌরাঙ্গনানাং
                           লোলাপাঙ্গৈর্যদি ন রমসে লোচনৈর্বঞ্চিতোহসি।।    (শ্লোক ২৮)

অর্থাৎ সেখানে যে সুন্দরীরা আছে, তাদের চঞ্চল চোখের চাহনিতে যে বিদ্যুৎ চমকে উঠে তাতে বিমোহিত না হলে মেঘ দারুণভাবে বঞ্চিত হবে। এরপর নির্বিন্ধ্যা নদী (বিন্ধ্য পর্বতজাত নদী) দেখে মেঘের নানাভঙ্গির কথা মনে হবে। ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস , ঘূর্ণিপাতে নাভির আবেদন, আবার ক্ষীণ, কৃশ জলধারায় বিরহের রূপ অঙ্কিত থাকবে। সেই অল্পপানির জলধারা মেঘেরই অপেক্ষা করছিল। তাঁর বর্ষণে সে আবার পূর্ণ হবে।

এরপর যক্ষ মেঘকে বিশালা রাজ্যের গৌরব উজ্জয়িনীর শোভা ও আকর্ষণ বর্ণনা করে। এই শহরটি যেন স্বর্গের এক ছটাক পরিমাণ কান্তি নিয়ে ভারতে বিরাজামান। সেই শহরের ধারে শিপ্রানদীর বাতাসে ভেসে আসবে প্রস্ফুটির পদ্মের আমোদিত সুগন্ধ এবং ফুরফুরে মেজাজের সারসদের কলতান। আর সে বাতাসের ছোঁয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাবে, যেমন করে রতিপ্রার্থী প্রণয়ীর আমুদে সোহাগে কামান্তে অঙ্গবেদনা জুড়িয়ে যায়ঃ

যত্র স্ত্রীনাং হরতি সুরতগ্লানিমঙ্গানুকূলঃ
                   শিপ্রাবাতঃ প্রিয়তব ইব প্রার্থনাচাটুকারঃ।।    (শ্লোক ৩২)

সে শহরে এসেই মেঘ পাবে ললিতাদের পায়ের আলতা রাঙ্গানো ভবনের দেউরি, তাদের কেশ প্রসাধনের গন্ধে মৌ মৌ করবে চারদিক। আর এতেই মেঘের পথের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। এই নগরেই সে দেখা পাবে মহাদেব শিবের পুণ্যধাম। সেই ত্রিলোকগুরুর উঠোনে বেলা গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত মেঘকে থাকতে বলে দেয় যক্ষ। সেখানে কিছুকাল কাটালে রাত শুরু হলেই মেঘ নগরীর নর্তকীদের দেখতে পাবে। যাদের চাহনির ব্যঞ্জনাতে মেঘ পর্যন্ত তৃপ্ত হতে বাধ্য। তাদের নাচের আশ্চর্য সুচারু বর্ণনা করে কালিদাস। নাচের তালে তারা তাদের মেখলাতে আলোড়ন তুলে এবং রত্নশোভিত চামড়ার কোমরবন্ধনী নেড়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। মেঘের প্রথম বৃষ্টির ছাঁট পেয়ে তারা বাহু উত্তোলিত করে নাচবে আর ভক্তি ভরে মেঘকে সম্মান জানাবে। 
রাত আরেকটু গভীর হলেই মেঘ দেখতে পাবে নগরীর অভিসারলিপ্সু রমণীরা চলছে প্রণয়ীদের ভবনে। যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করে তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিতে। গর্জন না করে হালকা বিজলি চমকিয়ে তাদের পথ পাড়ি দেয়া সহজ করে দিতে বলছে যক্ষঃ

গচ্ছন্তীনাং রমণবসতিং যোষিতাং তত্র নক্তং
রুদ্ধালোকে নরপতিপথে সূচিভেদ্যৈস্তমোভিঃ।
সৌদামিন্যা কনকনিকষস্নিগ্ধয়া দর্শয়োর্বীং
                   তোয়োৎসর্গস্তনিতমুখরো মাস্ম ভূর্বিক্লবাস্তাঃ।।   (শ্লোক ৩৮)

মেঘের এ যাত্রার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে মেঘের স্ত্রী বিদ্যুৎকে। তো রাতের এই অভিযানে যদি সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেজন্য যক্ষ মেঘকে কোন অট্টালিকায় বিশ্রাম নিতে বলছে যেখানে পায়রারা ঘুমিয়ে থাকবে। সূর্য উঠলে আবার শুরু হবে তার উত্তরে যাত্রা।
এ পর্যায়ে এসে কবিতায় নারীবিরহের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা যায়। অবন্তী ছেড়ে দিতে মেঘকে সে তাড়া দেয় সূর্যোদয় হবার সাথে সাথে। কারণ, প্রথম সূর্যের আলোতে দুঃখিনী নারীদের সারারাত পতিবিরহের কান্নার দাগ শুকিয়ে যাবে। অথবা পতিরা ঘরে ফিরে সেই অশ্রুধারা মুছে দিবে। অতএব, সেই আবেগী মুহূর্তে মেঘ যেন ছায়া দিয়ে অভিশপ্ত না হয় সেজন্য যক্ষ বলেঃ

তস্মিন্ কালে নয়নসলিলং যোষিতাং খণ্ডিতানাং
শান্তিং নেয়ং প্রণয়িভিরতো বর্ত্ম ভানোস্ত্যজাশু।
প্রালেয়াশ্রং কমলবদনাৎ সোঽপি হর্তুং নলিন্যাঃ
                      প্রত্যাবৃত্তস্ত্বয়ি কররুধি স্যাদনল্পাভ্যসূয়ঃ।।    (শ্লোক ৪০)

এই ৪০ নং শ্লোকে তৎকালীন সমাজে বিবাহিতা নারীর অবস্থা অনেকখানি পরিষ্কার হয়। অধিকাংশ সময়েই তাঁরা হতেন অশিক্ষিতা, গৃহকর্ম ও সন্তানপালন ছাড়া বাকি কাজে অপটু। ফলে, অবস্থাবান পুরুষেরা সংস্কৃতির ছোঁয়া পেতে ও আমুদে রাত কাটাতে সুশিক্ষিত, কালচারাল, নাচে-গানে পটু নগরবনিতাদের ভবনে চলে যেতো। এইরূপ বহুগমন মহাভারতে দেখা গেলেও তা কেবল মুনী, উপদেবতা, ঋষিপত্নী, স্বর্গীয় অপ্সরা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ জীবনযাত্রায় নারীদের অবস্থান যে বেশ নিচুতে ছিল, তা চোখ আঙ্গুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলেও বুঝা সম্ভব ।
উজ্জয়িনী ত্যাগ করে গম্ভীরা নদীর দেখা পাবে মেঘ। তার পাড়ে ঝুঁকে থাকা বেতের শাখা দেখে তরুণীর হালকা হাতে গায়ের কাপড় ধরে রাখার কথা মনে হবে। তখন মেঘ যেন মৃদু মন্থরে সেটি সরিয়ে দিয়ে তটকূল উন্মুক্ত করে দেয়। আর এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় মেঘের ছেড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে যক্ষ মেঘকে সাবধান করে দিচ্ছে। কারণ ' বিবৃত বা উদাম জঘনের স্বাদ একবার পেলে কে ভুলতে পারে!?' কাব্যিক ভাষায়ঃ

তস্যাঃ কিং চিৎ করধৃতমিব প্রাপ্তবানীরশাখং
হৃত্বা নীলং সলিলবসনং মুক্তরোধোনিতম্বম্।
প্রস্থানং তে কথমপি সখে লম্বমানস্য ভাবি
                        জ্ঞাতাস্বাদো বিবৃতজঘনাং কো বিহাতুং সমর্থঃ।।    (শ্লোক ৪২)

পরবর্তী চারটি শ্লোক দেবসেনাপতি কার্তিককে উদ্দেশ্য করে। কারণ অত্র এলাকা পৌরাণিকমতে, কার্তিকের অধিকারে। দেবগিরিতে মেঘের আগমনে হাতির উচ্ছ্বাস ও পাকা ডুমুরের আতিশয্যে সেই এলাকা সচকিত হবে। আর সেই দেবগিরিতে কার্তিকের সেনাবাহিনীর উপর আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথের ভেজা মালবিকা দিয়ে আশীর্বাদের বর্ষণ করে যেতে অনুরোধ করে যক্ষ। আর এই একই সময় কার্তিকের বাহন ময়ূর নেচে উঠবে আর তাদের স্খলিত পুচ্ছ (বর্ষার শেষে ময়ূরের পুচ্ছ আপনি খসে পড়ে, ৪/৫ মাস পর আপনিই গজায়। বর্ষা এদের প্রজনন ঋতু) তুলে নিয়ে তাঁর মাতা গৌরী তাঁর কানের পাশে পদ্মফুলের কলির পাশে পরে নেন। এ ধরণের অসাধারণ রূপকল্পের জন্যই তো মেঘদূত অতুলনীয়। শ্লোক ৪৫ কার্তিক ও গৌরীকে নিয়ে এভাবে বলেঃ

জ্যোতির্লেখাবলয়ি গলিতং যস্য বর্হং ভবানী
পুত্রপ্রেম্ণা কুবলযপদপ্রাপি কর্ণে করোতি।
ধৌতাপাঙ্গং হরশশিরুচা পাবকেস্তংমযূরং
পশ্চাদর্দ্রিগ্রহণগুরুভির্গর্জিতৈর্নর্তয়েথাঃ।।

শ্লোক ৪৬ এ কার্তিকের সেই অঞ্চল ছেড়ে আসার সময় যক্ষ মেঘকে পূর্ববর্তী এক রাজা রন্তিদেবের কীর্তিকে সম্মান দিয়ে আসতে বলে। পুরাণমতে, দশপুরের রাজা রন্তিদেব একবার গোমেধযজ্ঞ করেছিলেন সুরভি-সন্তান অর্থাৎ গরু উৎসর্গ করে। সেই গোবধের কারণে নাকি চম্বল নদীর সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এই বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য বিদ্যমান। অনেকে রামায়ণ, মহাভারতের উদাহরণ টানেন, তো কেউ বেদবাণী অনুসারে এর বিচার করেন। সোজা বাংলায়, অনেকে বলে থাকেন, গোহত্যা ও ভক্ষণ এক সময় ভারতে প্রচলিত ছিল। অনেকে বলেন, কোন সময়েই ছিল না। এই বচসা এ পর্যন্তই রাখি।

শ্লোক ৪৭ এ আসে কৃষ্ণ প্রসঙ্গ। শার্ঙ্গী বলে সম্বোধিত হন বিষ্ণুর বর্ণচোরা এ অবতার। আর এরপরেই চলে আসে দশপুরের বধূদের প্রসঙ্গ। তাদের ভ্রূলতার খেলা, আর চোখের পল্লবের তাড়নে কৃষ্ণ মণি ধবল পটভূমিতে ঝিলিক দিয়ে উঠে। কালিদাস কামুকতা রেখে বেশি ক্ষণ যে পঙক্তি রচনা করতে পারেন না, তা বারবার আমরা দেখি। এরপরেই মেঘ অতিক্রম করবে কুরুক্ষেত্র, যেখানে মহাভারতের কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল। অর্জুনের বীরত্বগাঁথা তখন মনে পড়বে মেঘের। সেই একসময়ের তপ্ত রণভূমিতে মেঘ আজ ছায়া বিলিয়ে যাবে।
কুরুক্ষেত্র পেরিয়ে মেঘ পৌঁছে যাবে ত্রিবেণীতে। বুদ্ধদেব বসুর মতে এই ত্রিবেণী সঙ্গম  বর্তমান প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদে। যদিও কুরুক্ষেত্র থেকে এই ত্রিবেণী প্রায় ৯০০ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে। ত্রিবেণীতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদী এসে মিশেছে। এই সরস্বতী নদী এখন আর নেই। তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় এর পাড়ে নিরপেক্ষ বলরাম বাস করেছেন বলে কালিদাস আমাদের জানাচ্ছেন। আর মেঘকেও তিনি সেই সরস্বতী নদীর পানি সেবন করে হৃদয় নির্মল করে নেবার পরামর্শ দেন। এরপরেই সে পৌঁছে যাবে হরিদ্বারের কনখলে। অলকনন্দা ও ভাগিরথী নদীর মিলনে দেবপ্রয়াগে সৃষ্টি হয় গঙ্গা নদীর। এই গঙ্গা এরপর ঋষিকেশের ত্রিবেণীঘাট (আমার মতে, এই ত্রিবেণীই অধিক যুক্তিযুক্ত) অতিক্রম করে ৯০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে হরিদ্বারে এসে হিমালয়ের উচ্চভূমি (২২,০০০ ফুট) থেকে ভারতীয় সমভূমিতে (৫০০ ফুট) নেমে আসে। আর এস্থানের উপমায় কালিদাস পার্বতী প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। গৌরীর চোখ রাঙ্গানো সত্ত্বেও মুহুর্মুহু জলরাশির উদ্যম উচ্ছ্বাসে গঙ্গা হরিদ্বারে আছড়ে পড়ছে আর শম্ভুর (শিব) চাঁদ-ধারণকারী চুলের গোছা তুলে নাচাচ্ছে। এই উপমার মাহাত্ম্য এখানে যে, উমা (দুর্গা) প্রকৃত অর্থে গঙ্গার বোন। উভয়ই পর্বতরাজ হিমালয় ও মেনকার কন্যা। সেজন্য দুর্গার অপর নাম পার্বতী। দুই বোনের খুনসুটি বা ঈর্ষার কথা এখানে উল্লেখ করতে চেয়েছেন কালিদাস।

তস্মাদ্ গচ্ছেরনুকনখলং শৈলরাজাবতীর্ণাং
জহ্নোঃ কন্যাং সগরতনয়স্বর্গসোপানপংক্তিম্‌।
গৌরীবক্ত্র ভ্রুকুটিরচনাং যা বিহস্যেব ফেনৈঃ
                     শম্ভোঃ কেশগ্রহণমকরোদিন্দুলগ্নোর্মিহস্তা।।    (শ্লোক ৫১)

হরিদ্বার থেকে আরো উত্তরে এগিয়ে গেলেই পাহাড়ি হাতির যূথ, হরিণের দল আকীর্ণ এলাকা পার হয়ে গঙ্গার উৎস মানস সরোবরের দেখা পাবে মেঘ। যার বরফের গলিত ধারায় গঙ্গা বয়ে চলে। সেখানে দেবদারু গাছের ডালের ঘষায় যদি দাবানল দেখা দেয় ও চামর নামের পাহাড়ি মহিষের লোম পুড়িয়ে দেয়, তবে মেঘ যেন পানি ঝরিয়ে সে আগুন ঠাণ্ডা করে। আর পাহাড়ি সিংহ (মতান্তরে তুষারমানব) যদি লাফ দিয়ে মেঘকে আক্রমণ করতে চায়, তবে মেঘ যদি শিলাবর্ষণ করে তাহলে তারা পরাস্ত হবে বলে মনে করে যক্ষ।
এই শিবের লীলাক্ষেত্রে এসে মেঘ যেন মহাদেবকে ভক্তিভরে পূজা দিতে ভুল না করে। শ্লোক ৫৬ ও ৫৭তে শিবের স্তুতি নিয়ে আবেগঘন পঙক্তি আছে। যা থেকে অনেকেই ধারণা করেন, কালিদাস শৈব বা শিবভক্ত ছিলেন। এর কিছু পরেই মেঘ পাবে কৈলাসের সন্ধান। কেলির আবাস বা সম্ভোগের বাড়ি হল শিব-পার্বতীর বাসস্থান।  আর রাবণ একবার এই কৈলাস তুলে নিয়ে লঙ্কায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। গিরিতলে সে পাহাড় উঠানো নিয়ে যুদ্ধ করার সময় মহাদেব পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কৈলাস আটকে রাখলেন ও ত্রস্তা গৌরীকে আশ্বস্ত করতে লাগলেন হাত দিয়ে। এই দৃশ্য ইলোরা ও এলিফ্যান্টা গুহায় খুদিত আছে। বাংলাদেশেও বহু কষ্টিপাথরের ও মূল্যবান পাথরের উপর খোদাই করা এই দৃশ্য দেখা যায় নানা যাদুঘরে।
আর এখানে কালিদাস নিয়মাবদ্ধ সংস্কৃত রীতির বাইরে গিয়ে কৈলাসের শুভ্রতার সাথে শম্ভুর শুভ্র অট্টহাসির তুলনা এঁকে দেন মনোরম নৈপুণ্যেঃ

গত্বা চোর্ধ্বং দশমুখভুজোচ্ছ্বাসিতপ্রস্থসন্ধেঃ
কৈলাসস্য ত্রিদশবনিতাদর্পণস্যাতিথিঃ স্যাঃ।
শৃঙ্গোচ্ছ্রায়ৈঃ কুমুদবিশদৈর্যো বিতত্য স্থিতঃ খং
                      রাশীভূতঃ প্রতিদিনমিব ত্র্যম্বকস্যাট্টহাসঃ।।    (শ্লোক ৫৯)

এমতাবস্থায় সেখানে পার্বতী যদি আবির্ভূত হন, তবে মেঘের সেখানে আর থাকা ঠিক হবে না। সে যেন বৃষ্টি না ঝরিয়ে ধীরে ধীরে কৈলাস ত্যাগ করে। সেখানে স্বর্গপুরীতে দুষ্টু যুবতীরা খরগ্রীষ্মে যদি মেঘকে পেয়ে ছাড়তে না চায় তাঁর সাথে ক্রীড়ায় মগ্ন হওয়ার জন্য, তখন মেঘকে কঠিন সুরে ধমক (মেঘের অঘোষ) দিয়ে দেবার উপদেশ দেয় যক্ষ। এর থেকে কিছুদূর এগোলেই অলকা-এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে পূর্বমেঘ শেষ হয়।
এখানে একটি জিনিস খেয়াল করার মতো যে, যক্ষ তাঁর বিরহের কথা তাঁর পত্নীর কাছে পৌঁছাতে দূত পাঠালেও মেঘকে দিক-নির্দেশনা দিতে তাঁর কোন তাড়া নেই। বিভিন্ন পর্বতের মাথায় মেঘকে বিশ্রাম নিতে বলছে। যক্ষের প্রিয় জায়গাগুলো দিয়ে তাঁকে যেতে বলছে। জল ছড়িয়ে পানি প্রত্যাশীদের পিয়াস মিটিয়ে আবার পথের নানা নদী-সরোবর থেকে মেঘের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতে বলছে। এখানে, তাই মনে হয় কালিদাস যেন চিঠি পাঠানোর চেয়ে চিঠি পাঠানোর রাস্তা দেখিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী। কালিদাসের শৃঙ্গারপ্রীতি নাই তা বলা যাবে না। মাঝে মাঝে সেই রসটাই মুখ্য বলে মনে হবে।
তারপরও রাস্তার বর্ণনা হল পূর্বমেঘ, কিন্তু জগৎবিদিত হল যক্ষিণী ও উত্তরমেঘ।

উত্তরমেঘ

পূর্বমেঘের ভারত মর্ত্যের বর্ণনা শেষ করে উত্তরমেঘে আমরা পাই কাল্পনিক শহরের দেখা। আর এখানেই আমরা নায়িকার দেখা পাই, যার জন্য মেঘ সুদূর বিন্ধ্য পর্বতের রামগিরি থেকে ছুটে আসছে।
প্রথমেই আসে অলকার নয়নাভিরাম রূপবৈশিষ্ট্য। অলকার বাড়িগুলোতে রংধনুর নকশা, বিদ্যুৎ সুলভ যুবতী, গান রচনার উদ্দেশ্যে পাখোয়াজে মৃদু-মন্দ বোল - এমন বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। অলকার মেঝে এত স্বচ্ছ যে মেঘের কাছেও তা মেঘ মনে করে ভুল হবে। কালিদাসের ভাষায়ঃ

বিদ্যুৎবন্তং ললিতবনিতাঃ সেন্দ্রচাপং সচিত্রাঃ
সঙ্গীতায় প্রহতমুরজাঃ স্নিগ্ধগম্ভীরঘোষম্।
অন্তস্তোয়ং মণিময়ভুবস্তুঙ্গমভ্রংলিহাগ্রাঃ
                        প্রাসাদাস্ত্বাং তুলয়িতুমলং যত্র তৈস্তৈর্বিশেষৈঃ।।    (শ্লোক ৬৫)

অলকার নন্দনগাঁথা আরো চমৎকার। এ বাগানে ষড়ঋতুর ফুল একসাথে ফুটে থাকে। পদ্ম (শরৎ), মল্লিকা গোত্রের কুন্দকলি বা কুঁদকলি (হেমন্ত), লোধ্র (শীত), কুরুবক বা ঝিন্টি বা মোরগফুল (বসন্ত), শিরীষ (গ্রীষ্ম), কদম (বর্ষা) - এদেরকে অলকার ললনারা নানাভাবে অলংকার ও শোভনের কাজে ব্যবহার করে। 
এরপর শুরু অলকাবাসীদের বর্ণনা।
অলকার অধিবাসীরা চকচকে উদ্যানে বসে বিশ্রাম নেয় যেখানে স্বচ্ছ মেঝেতে তারার আভা দেখে ছিটানো ফুল ভেবে ভুল হয়। আর সেসময় তারা আমোদে মেতে উঠে মদিরা পানের মাধ্যমে। তারা রতিফলমদ্য পান করে যা একটি দুধ-মধু-আখেররস দিয়ে তৈরি ককটেলবিশেষ। স্বর্গ ছাড়াও মর্ত্যে একসময় মদ বিপুলাকারে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। 
সে মদের আসরে রত্ন দিয়ে বাতি জ্বলে আছে। আর সেসময়ে প্রণয়ীরা আবেগে হঠাৎ করে প্রেমিকাদের পরিধেয় লিনেন খসিয়ে দেয়। আর লজ্জায় তারা কুমকুম গুঁড়ো ঐ রত্নশিখায় ছিটিয়ে দেয় বাতি নিভিয়ে দিতে। কিন্তু হায়! তাদের চেষ্টা বিফল হয়। আলো নিভে না। কালিদাসের কলমেঃ

নীবীবন্ধোচ্ছ্বসিতশিথিলং যত্র বিম্বাধরাণাং
ক্ষৌমং রাগাদনিভৃতকরেষ্বাক্ষিপৎসু প্রিয়েষু
অর্চিস্তুঙ্গানভিমুখমপি প্রাপ্য রত্নপ্রদীপান্
                        হ্রীমূঢ়ানাং ভবতি বিফলপ্রেরণা চূর্ণমুষ্টিঃ।।     (শ্লোক ৭১)

এই অলকাপুরীতেই মেঘেরা নিয়মিত যাতায়াত করে। আবার বাতাসের তাড়নায় এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়, কখনো উচ্চদালানের থেকে শীর্ণ হয়ে বের হয়, কখনো দূরে মিলিয়ে যায়। আর সে রাতেই যখন চন্দ্রমণি (Moonstone) শোভিত বাগানে চাঁদের আলো এসে লাগে তখন যেন পুরো এলাকায় চাঁদের জলকণা ছড়িয়ে আছে মনে হয়। সে জলকণাগুলোকে শৃঙ্গারশেষে নায়িকাদের ক্লান্তি মুছে নেয় আর তাদের পাশে শুয়ে থাকে বিগলিত ও তৃপ্ত প্রণয়ীরা। কবি বলেনঃ

যত্র স্ত্রীণাং প্রিয়তমভুজোচ্ছ্বাসিতালিঙ্গনানা-
মঙ্গগ্লানিং সুরতজনিতাং তন্তুজালাবলম্বাঃ
ত্বৎসংরোধাপগমবিশদৈশ্চন্দ্রপাদৈর্নিশীথে
                       ব্যালুম্পন্তি স্ফুটজললবস্যন্দিনশ্চন্দ্রকান্তাঃ     (শ্লোক ৭৩)

উজ্জয়িনীর মতো এখানেও রাতে মেয়েরা অভিসারে মগ্ন হয়। মেঘ একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবে- হাঁটার ত্রস্ততায় ছুটে যাওয়া মন্দার ফুল, কানের থেকে খুলে আসা সোনার পদ্ম, স্তনের ঝাঁকুনিতে ছিন্ন হার আর মুক্তাজাল। সূর্যের আলোতে মেঘ মেয়েদের হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাগজের নকশাগুলোও পড়ে থাকতে দেখবে যা দিয়ে ঐ চঞ্চল নারীরা অভিসারের জায়গা ঠিক মতো বুঝে নিত।

গত্যুৎকম্পাদলকপতিতৈর্যত্র মন্দারপুষ্পৈঃ
পত্রচ্ছেদৈঃ কনককমলৈঃ কর্ণবিভ্রংশিভিশ্চ।
মুক্তাজালৈঃ স্তনপরিসরশ্ছিন্নসূত্রৈশ্চ হারৈ-
                      নৈশো মার্গঃ সবিতুরুদয়ে সূচ্যতে কামিনীনাম্।।    (শ্লোক ৭৫)

কন্দর্প বা মদন দ্বারা প্রাভাবিত হয়ে অলকার নারীরা সকল ধরণের প্রসাধন ব্যবহার করে বিচরণ করে অলকাতে। তারা আবার প্রণয়ীর সন্ধানে নিতান্ত নির্ভুল। শাস্ত্রমতে নারীদের বসন চার রকমের যেগুলো অলকার নারীরা পরে আছেঃ
১। কচধার্য বা কেশধার্য - কচি পাতাসহ ফুল
২। দেহধার্য - অলংকার
৩। পরিধেয় - বিচিত্র রঙিন বাস
৪। বিলেপন - অলক্তক
সংস্কৃতের কচকচানিতেঃ

বাসশ্চিত্রং মধু নয়নয়োর্বিভ্রমাদেশদক্ষং
পুষ্পোদ্ভেদং সহ কিসলয়ৈর্ভূষণানাং বিকল্পান্
লাক্ষারাগং চরণকমলন্যাসযোগ্যঞ্চ ষস্যা-
                       মেকঃ সূতে সকলমবলামণ্ডনং কল্পবৃক্ষঃ।।    (শ্লোক ৭৭)

এরপরের শ্লোকগুলোতে যক্ষ তাঁর ভবনের বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে মেঘকে। কি কি দেখে সে চিনবে যে ঐ বাড়িতেই তাঁর বার্তা দিতে হবে। প্রথমেই যক্ষ বলে রংধনুর মতো বিশাল তোরণ যা কুবেরের প্রাসাদ ছাড়িয়ে আরো উত্তরে। তারই পাশে আছে যক্ষপ্রিয়ার সন্তানতুল্য তরুণ মন্দারগাছ। আর পাশেই দেখতে পাবে একটি হ্রদ যার সিঁড়ি মরকত বা পান্না শোভিত আর নীলকান্ত দিয়ে সাজানো অজস্র পদ্মের কান্ড। কাছেই মানস জেনেও হাঁসেরা যক্ষের হ্রদেই ঘুরে বেড়ায়। এমনকি মেঘের আসাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তারা সেখানেই আরামসে চলতে থাকবে। এই হ্রদের পাশেই আছে যক্ষ আর যক্ষপ্রিয়ার প্রমোদশৈল (খেলার জন্য উঁচু ঢিবি বুঝাচ্ছে)। এবং যক্ষের বাড়ির সামনে আছে অপরূপ এক বাগান যাতে শোভা পাচ্ছে কুরুবক, বকুল ও রক্ত বর্ণের অশোক। আর এখানেই এক স্বর্ণের আসনে রোজ এক ময়ূর এসে বসে।যে ময়ূরটি যক্ষপ্রিয়ার চুড়ি পরা হাতের তালির সাথে পেখম তুলে নাচে নিয়মিত। এসব চিহ্ন দেখেই মেঘ যক্ষের বাড়ি চিনবে। সে বাড়িতে দরজার পাশে মেঘ দেখবে শঙ্খপদ্মের ছবি আঁকা। কিন্তু এত উজ্জ্বল কিছু থাকার পরেও যক্ষ মনে করে তাঁর ভবন হয়ে থাকবে মলিন। কারণ সূর্যরূপ কর্তা সেখানে নেই! যক্ষের আত্মবিশ্বাস সত্যিই প্রশংসার দাবীদারঃ

ক্ষামচ্ছায়ং ভবনমধুনা মদ্‌বিয়োগেন নূনং
                        সূর্যাপায়ে ন খলূ কমলং পুষ্যতি স্বামভিখ্যাম্।।     (শ্লোক ৮৩)

এরপরের শ্লোকে যক্ষ মেঘকে বলছে তাঁর ঘরে ঢুকার উপায়। হাতির শাবকের রূপ ধরে আমোদশৈলের উপর দিয়ে ঘরের ভেতর তাকাবে। জোনাকি যেমন ধীরে ধীরে আলো জ্বালে, তেমনি বিদ্যুতের হালকা স্ফুরণে যক্ষপ্রিয়াকে দেখার পরামর্শ দেয় যক্ষ। 
পরবর্তী শ্লোকটিই ব্যাপক পরিচিত ও যক্ষপ্রিয়ার সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য উৎসর্গ করা। ৮৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছেঃ

তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ
শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাদ্ যুবতিবিষয়ে সৃষ্টিবাদ্যেব ধাতুঃ।।

 Yakhsa and Yakshini by Ram Gopal Vijaivargiya (Display: Maharaja Sawai Man Singh II Museum)
Source:
The Heritage Lab

কালিদাস বর্ণীত এ রূপের বর্ণনাকে এতদঞ্চলে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হতো, এখনো হয়তো (!) হয়। এর মানে কি? ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদক নানাভাবে রচনা করলেও মোটামুটি প্রেক্ষিত ভাব এরকম যে, হালকা গড়নের যুবতী (তন্বী) যার গায়ের রঙ কাঞ্চন (হালকা স্বর্ণালী) বা অনেকের মতে শ্যামলা (শ্যামা)। তার দাঁত হবে চিকন (শিখরিদশনা)। ঠোঁট যেন পাকা বিম্বফলের মতো লাল (পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী)। ক্ষীণ কোমরে (মধ্যে ক্ষ্যামা) গভীর নাভি শোভা বাড়াবে (নিম্ননাভি)। আর চোখে থাকবে চমকে উঠা চঞ্চল হরিণের চাহনি (চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা)। স্তনজোড়া ভারে কিছুটা নুইয়ে থাকবে (স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং)। ভারী নিতম্বের কারণে তার চলন হবে ঈষৎ ধীর ও মন্দ লয়ের (শ্রোণীভারাদলসগমনা)। এমন রূপের প্রতিমা এজন্যই প্রকৃষ্ট যে, সে হল স্রষ্টার প্রথম সৃষ্টি। নরেন্দ্র দেব লিখেনঃ

তন্বী তরুণী, শ্যামলিম তনু, শিখরোজ্জ্বল দশন পুট,
পক্ব বিম্ব অধর ওষ্ঠ, ক্ষীণ কটি তার, নাভিটি কূট,
চকিত-হরিণী নয়নের দিঠি, অলস গমনাশ্রোণীর ভারে;
কুচ চাপে নত যুবতী-যেন বা বিধাতে প্রথম সৃজিল তারে।

আবার বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ করেনঃ

তন্বী, শ্যামা, আর সুক্ষ্মদন্তিনী, নিম্ননাভি, ক্ষীণমধ্যা,
জঘন গুরু বলে মন্দ লয়ে চলে, চকিত হরিণীর দৃষ্টি
অধরে রক্তিমা পক্ক বিম্বের, যুগল স্তনভারে ঈষৎ-নতা,
সেথায় আছে সে-ই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা।

মূলের অসামান্য কাব্যমাধুর্য রেখে অনুবাদ করা নীলমণি নন্দী লিখেছেনঃ

জিজ্ঞাস যদ্যপি তুমি, কেমনে জানিবে,
কে আমার প্রিয়া, বলি শুন তবে তার
যেবা রূপ - দন্তপংক্তি যথা মণিপংক্তি,
ওষ্ঠাধর কিবা পক্কবিম্বসম, শ্যামা
মধ্যক্ষীণা, মৃগী-দৃষ্টি, সুগভীর নাভিঃ।
চারু পীন স্তন ভারে, ঈষৎ নম্রা, প্রিয়া,
অলস গমন তার দেখিবে হে তুমি
কিবা নিতম্বের ভরে, অম্বুধর! হায়!
যুবতী বিষয়ে প্রিয়া, বিধাতার আদি 
সৃষ্টি.......................................।।

আবার রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যানঃ

হীরকদশনা তন্বী পক্কবিম্বাধরা
শ্যামা মধ্যক্ষামা নিম্ননাভি মনোহরা।
চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না
নিবিড় নিতম্ব ভরে মন্থর গমনা।
স্তনভরে আছে দেহ স্তোক নম্র হয়ে
বিধিআদ্য সৃষ্টি তিনি যুবতী বিষয়ে।

আরেকটি উৎকৃষ্ট অনুবাদ করেছেন রবি ঠাকুরের জ্যেষ্ঠতম ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ

প্রিয়ারে পাইবে দেখা,    গাময় লাবণ্যরেখা,
পয়োধরে ফুলিছে যৌবন।
তনু তার কলেবর,        কটী তার ক্ষীণতর 
স্তনভার করয়ে বহন।
বাঁধিবারে অনুরাগ,        অধরে বিম্বের রাগ,
মৃগ-আঁখি প্রণয়ের আধার।
দেখিলে আকৃতি তার,     মনে হয় সবাকার,
আদিসৃষ্টি বুঝি বা ধাতার।

আবার বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক আর্থার উইলিয়াম রাইডার যিনি বলেছেন, "Kalidas has created a genre in itself by The Cloud Messenger. It is nothing like The Birth of the War-God and The Dynasty of Raghu". তাঁর অনুবাদে আমরা পাইঃ


The supremest woman from God's workshop gone-
Young, slender; little teeth and red, red lips,
Slight waist and gentle eyes of timid fawn,
An idly graceful movement, generous hips,
Fair bosom into which the sloping shoulder slips-

রূপের বর্ণনায় কাব্যের এই শ্লোক সংস্কৃত তো বটেই, বিশ্বের অনেক ভাষার সাহিত্যের মধ্যে এক ও অদ্বিতীয়। বুদ্ধদেব এই প্রসঙ্গে স্কটিশদের জাতীয় কবি Robert Burns এর রমণী সম্পর্কিত এক কবিতার অংশ তুলে ধরেনঃ

Auld Nature swears, the lovely dears
Her noblest work she classes, O:
Her prentice han' she try'd on man,
                                                    An' then she made the lasses, O.  (Green Grow The Rashes: 1798)

আবার কালিদাস যার রচনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তাঁর বেশির ভাগ লেখা সমৃদ্ধ করেছেন, সেই বাল্মীকির রামায়ণে নারীরূপের বর্ণনার এক অসামান্য উদাহরণ আমরা পাই। পরিব্রাজকের বেশে রাবণ দণ্ডকারণ্যে সীতাকে প্রথমবারের মত দেখে বলে উঠেঃ

সমাঃ শিখরিণাঃ স্নিগ্ধাঃ পাণ্ডুরা দশনাস্তব।
বিশালে বিমলে নেত্রে রক্তান্তে কৃষ্ণতারকে।।
বিশালং জঘনং পীনমূরূ করিকরোপমৌ।
এতাবুপচিতৌ বৃত্তৌ সংহতৌ সম্প্রগল্‌ভিতৌ।।
পীনোন্নতমুখৌ কান্তৌ স্নিগ্ধতালফলোপমৌ।
                                          মণিপ্রবেকাভরণৌ রুচিরৌ তৌ পয়োধরৌ।।       (অরণ্যকাণ্ডঃ সর্গ ৪৬)

অনুবাদঃ
"তোমার দশনরাজি সমান সুগঠিত চিক্কন ও শুভ্র। নেত্র নির্মল ও আয়ত, অপাঙ্গ রক্তাভ, তারকা কৃষ্ণবর্ণ। নিতম্ব বিশাল ও স্থূল, ঊরুদ্বয় হস্তীশুণ্ডের ন্যায়। তোমার ওই উচ্চ বর্তুলদৃঢ় ও লোভজনক স্তনযুগল উত্তম মণিময় আভরণে ভূষিত। তাদের মুখ পীনোন্নত, গঠন স্নিগ্ধ তালফলের তুল্য সুন্দর।"(রাজশেখর বসু)
"তোমার দন্তসকল সমচিক্কণ পাণ্ডুবর্ণ ও সূক্ষ্মাগ্র, নেত্র নির্মল, তারকা কৃষ্ণ ও অপাঙ্গ রক্তিম, তোমার নিতম্ব মাংসল ও বিশাল ঊরু করিশুণ্ডাকার এবং স্তনদ্বয় উচ্চ সংশ্লিষ্ট বর্তুল কমনীয় ও তালপ্রমাণ, উহার মুখ উন্নত ও স্থূল, উহা উৎকৃষ্ট রত্নে অলঙ্কৃত ও যেন আলিঙ্গনার্থে উদ্যত রহিয়াছে!"
(হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য)

হঠাৎ ধাক্কার মতো লাগলেও উপরের অংশগুলো মোটেও বানোয়াট নয়। নারীবন্দনার এ এক অতি প্রাচীন ব্যবহৃত পন্থা।
যাই হোক মেঘদূত থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। তবে এই ঘোরানো পথ উপভোগ্যই ছিল।
আমরা একটু ভালভাবে যদি খেয়াল করি, তবে দেখব মেঘদূতের ৮৫ নং শ্লোকের শেষ অংশে কালিদাস বলছেন যক্ষিণী সৃষ্টির উৎকৃষ্ট উপমা কারণ তাঁকে বিধাতা সবার প্রথমে সৃষ্টি করেছে। এ মতামতের বিরুদ্ধাচরণই কিন্তু বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলোতে আমরা দেখি, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবার শেষে। এবং নিঃসন্দেহে নারীরূপ মানবরূপের শ্রেষ্ঠরূপ। আবার সংস্কৃতে এসেও আমরা দেখি এই রামায়ণেই সুন্দরকাণ্ডে রাবণ সীতাকে ভোলানোর জন্য অশোকবনে বলছে, সে স্রষ্টার শেষ কীর্তি। আবার John Milton ঈভের প্রতি বলে উঠেনঃ

O fairest of all creation, last and best
Of all God's works, creature in whom excelled
Whatever can to sight or thought be formed,
                               Holy, divine, good, amiable, or sweet!     (Paradise Lost)

দুই দিক থেকেই যুক্তি আছে। প্রথমের দিকে হলঃ স্রষ্টা সর্বাধিক যত্ন আর ধৈর্য নিয়ে এই সৃষ্টিকে বানিয়েছেন। এটা বিধাতার নিখুঁত সত্ত্বার পরিচায়ক। অপরদিকেঃ শেষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়ার মানে হল ঈশ্বর ট্রায়াল এন্ড এররের মাধ্যমে শেষে এসে সঠিক সৌন্দর্যের মানে খুঁজে পেয়েছেন। এটি একদিক থেকে চিন্তা করলে তাঁর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বোঝানো হয়। তাঁকে তখন সঠিক পরিকল্পনাকারী ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে মানা যায় না। কালিদাসের ভক্তি ও বিশ্বাস এখানে সৃষ্টিকর্তাকে এক সীমাহীন উচ্চতায় উঠিয়ে দেয়। আবার মিল্টন ও অন্যান্যদের বচনেও শক্ত যুক্তি আছে এ কথা অনস্বীকার্য। এ তর্ক শেষ হবার নয়।
যাই হোক, রূপের উপাখ্যান এখানে শেষ করি।

এই সৌন্দর্য ঘোষণার পর শুরু হয় যক্ষিণীর বিরহের অবস্থা বুঝাতে কালিদাসের একের পর এক ছন্দিত অশ্রুবর্ষণ। শ্লোক ৮৬ থেকে ৯৯ পর্যন্ত প্রণয়ের বিভিন্ন দশার বর্ণনা আমরা পাই কালিদাসের কাছ থেকে। আমরা জানতে পাই, প্রিয়ার জন্য প্রণয়ানুভূতির দশটি দশা রয়েছে। সেগুলো হলঃ

১। চক্ষুপ্রীতিঃ- চোখের দেখায় ভালো লাগা
২। মনঃপ্রীতিঃ- মনের মিলন স্থাপিত হওয়া বা মন থেকে চাওয়া
৩। সঙ্গসংকল্পঃ- প্রিয়া বা প্রিয়কে কাছে পাওয়ার বাসনা
৪। অনিদ্রাঃ- আশা পূর্ণ না হলে ঘুম টুটে যাওয়া
৫। কৃশতাঃ- খাবারে অভক্তি আসাতে শুকিয়ে যাওয়া
৬। অবসাদঃ- মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া
৭। হ্রীত্যাগঃ- লজ্জা ত্যাগ মানে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছেতাই করা
৮। উন্মাদঃ- মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
৯। মূর্ছাঃ- প্রিয়ার বিহনে সংজ্ঞা হারানো
১০। মৃত্যুঃ- ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

যক্ষ মেঘকে যক্ষিণীর আটটি দশার বর্ণনা দিয়েছেন প্রথম ও শেষটি ছাড়া। শ্লোক ৮৬ শুরুই হয় এই বলে যে, "ওহে মেঘ, সে আমার দ্বিতীয় প্রাণ, এ কথা স্পষ্টভাবে জেনে নিও। আর তাই তো সে একা চক্রবাকী হয়ে নির্বাক বিরহে দিন কাটাচ্ছে।" চক্রবাক-দম্পতি বা চখা-চখীকে এই এলাকায় প্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিমে Turtle-dove এর মতো। কালিদাসের ভাষ্যেঃ

তাং জানীথাঃ পরিমিতকথাং জীবিতং মে দ্বিতীয়ং
                    দূরীভূতে ময়ি সহচরে চক্রবাকীমিবৈকাম্    (শ্লোক ৮৬)

কেঁদে কেঁদে যক্ষপ্রিয়ার এমন অবস্থা হয়েছে যে তাঁর স্বভাবসুলভ মোহনীয় রূপটি আর নেই। তাই মেঘ তাঁর অবিন্যস্ত কেশবাস, ফুলে উঠা চোখ দেখে যেন প্রেমের দৈন্যতা দেখতে পাবে। সেই সময়ে সে হয়তো আনমনে যক্ষের প্রতিকৃতিই কল্পনা করছে পূজার আসনে বসে। আর খাঁচার ময়না তাকে খোঁটা দিচ্ছে, "সোহাগী তুই তাঁর, স্বামীরে কি কখনো মনে পড়ে না, ওলো রসিকা?"
শ্লোক ৮৯ এ এসে যক্ষিণীর একটি অদ্ভুত প্রতিভার দেখা পাই আমরা। যক্ষ বলছে, তাঁর বিরহে কেঁদে সে মাঝে মাঝে বীণা হাতে তুলে নিয়ে সুর বাজাতে শুরু করে। সেই তান যক্ষকে নিয়েই তার নিজের বাঁধা। কিন্তু চোখের পানিতে ভেজা বীণার কারণে বহু অভ্যাসে তোলা সে সুর যক্ষিণী বারবার ভুলে যায়। সে ভেবেছিল যক্ষকে নিয়ে নিজের তৈরি করা গান ধরলে হয়তো তাঁর কষ্ট লাঘব হবে। কিন্তু তার বাসনা পূরণ হয় না। যক্ষ বলে চলেছেঃ

উৎসঙ্গে বা মলিনবসনে সোম্য নিক্ষিপ্য বীণাং
মদ্গোত্রাঙ্কং বিরচিতপদং গেয়মুদ্গাতুকামা
তন্ত্রীমার্দ্রাং নয়নসলিলৈঃ সারয়িত্বা কথঞ্চিদ্‌-
                         ভূয়োভূয়ঃ স্বয়মপি কৃতাং মূর্ছনাং বিস্মরন্তী।।     (শ্লোক ৮৯)

পরবর্তী শ্লোক প্রণয়ের তৃতীয় দশা প্রকাশ করছে। সংকল্প। যক্ষকে কাছে পেতে যক্ষপ্রিয়া প্রতিদিন বাড়ির দেউড়িতে একটি করে ফুল রেখে দিন গণনা করছে। আবার কখনো কল্পনায় সে পতির সঙ্গ উপভোগ করে। স্বপ্নে রতিভোগ করে যেমন অনেক কামবঞ্চিতা নারী বিনোদন খুঁজে পায়।

মৎসঙ্গং বা হৃদয়নিহিতারম্ভমাস্বাদয়ন্তী
                        প্রায়েণৈতে রমণবিরহেষ্বঙ্গনানাং বিনোদাঃ।।     (শ্লোক ৯০)

যক্ষপ্রিয়া বিরহে বিনিদ্র রজনী পার করে যাচ্ছে। যে রাতগুলো তার যক্ষকে পাশে নিয়ে কাটতো সেই রাতে পতিছাড়া সে শীর্ণদেহে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তাকে দেখে কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতে যে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উঠে তার কথা মনে পড়ে যেতে পাড়ে মেঘের।

             প্রাচীমূলে তনুমিব কলামাত্রশেষাং হিমাংশোঃ      (শ্লোক ৯২)

অবসাদ যক্ষিণীকে গ্রাস করতে থাকে। ঘরের জানালায় শীতল চন্দ্রিমা ছুঁয়ে গেলে স্বভাববশত সেদিকে তার চোখ ছুটে গেলেও যক্ষকে না দেখতে পেয়ে কান্নাভরা অতুলনীয় আঁখি সে নামিয়ে নেয়। আর সে এই আটমাস প্রসাধনমিশ্রিত জলে স্নান করা ছেড়ে দিয়েছে। স্বপ্নে আমার (যক্ষের) দেখা পাবে বলে ঘুমাতে গেলেও কান্নার চোটে তাও সে করতে পারে না। চুলের যত্নও সে নিচ্ছে না। যার কারণে তার বেণি এতোই রুক্ষ হয়েছে যে স্পর্শ করলে আঘাত লাগবে। বিদায়বেলায় যক্ষ নিজ হাতে যে বেণি বেঁধে দিয়েছিল তাই সে রেখে দিয়েছে। কুবেরের শাপমোচন হলে সে এসে খুলে দিবে। সে নখের যত্নও নিচ্ছে না। ডান হাতের নখ বড় হয়ে যাচ্ছে, যেখানে কামসূত্রমতে কেবল বাঁ হাতের আঙ্গুলে নখ বড় রাখার কথা বলা হয়। শ্লোক ৯৬ এ এসে যক্ষিণীর আমরা ত্রস্তা রূপ দেখতে পাই। কৃশতার জন্য তার গায়ের বসন খসে গেছে, বেদনায় সে বারবার উঠছে-বসছে। তার বিরহের চরম দশা সূচিত হচ্ছে। নবম দশা। শ্লোক ৯৭ যক্ষের গর্বোক্তি। সে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবছে যে তাঁর জন্য তাঁর প্রেয়সী এতখানি দুঃখ সয়ে অপেক্ষা করে আছে।
শ্লোক ৯৮ এ এসে মেঘ প্রথমবারের মত যক্ষপত্নীর দেখা পায়। মেঘ তার কাছাকাছি গেলে এলোচুলে, কাজল ছাড়া চোখ নিয়ে সে মেঘের দিকে তাকাবে। সে দৃষ্টিতে ভ্রূর খেলা থাকবে না কারণ যক্ষবিরহে যক্ষিণী মদ খাওয়াও ত্যাগ করেছে। তারপরও যক্ষিণীর এই উপরে তাকানোতে আমাদের অতি পরিচিত একটি উপমার উৎস আমরা পেয়ে যাই। কালিদাস যক্ষপ্রিয়ার মুখ তুলে তাকানোতে চোখের যে ভাব তা বোঝাতে বলছেনঃ

       মীনক্ষোভাচ্চলকুবলয়শ্রীতুলামেষ্যতীতি।।    (শ্লোক ৯৮)

যক্ষিণীর বিরহের দৈহিক লক্ষণ তুলে ধরতেও কালিদাস ভুল করেন না। যক্ষ প্রতিবার সম্ভোগান্তে যক্ষিণীর গায়ে ('রতিরহস্য' অনুযায়ীঃ "উদর, পার্শ্ববাহু, স্তন, ঊরু, শ্রোণী, বক্ষ - এসব নখক্ষতের স্থান") নখের আঁচড় দিয়ে দিত। এখন সেগুলো নেই বলে, তার ঊরু ঢাকার মুক্তাজাল (কোমরবন্ধনী যা জালের মত কোমরে বেঁধে রাখত এবং হাঁটুর উপর পর্যন্ত স্বচ্ছ আবরণ হিসেবে কাজ করত। এটি মূলত মূল পোশাকের উপর পরা হত।) এখন আর সে পরে না। 
এ পর্যায়ে এসে মেঘকে একটু অপেক্ষা করতে বলে যক্ষ। কেননা সে শেষ রাত্রে যক্ষপুরীতে পৌঁছেছে। প্রিয়ার স্বপ্নে তখন যক্ষ খেলা করছে, সেই ঘুম না ভাঙ্গিয়ে এক প্রহর অপেক্ষা করে মেঘকে ভোর হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলে যক্ষঃ

তস্মিন্ কালে জলদ যদি সা লব্ধনিদ্রাসুখা স্যা-
দন্বাস্যৈনাং স্তনিতবিমুখো যামমাত্রং সহস্ব।
মা ভূদস্যাঃ প্রণয়িনি ময়ি স্বপ্নলব্ধে কথঞ্চিৎ
                       সদ্যঃ কণ্ঠচ্যুতভুজলতাগ্রন্থি গাঢ়োপগূঢ়ম্‌।।     (শ্লোক ১০০)

এখন মেঘ যক্ষপ্রিয়ার ঘুম ভাঙ্গাবে। মেঘের প্রেমিকা বিদ্যুৎকে দিয়ে নয়। যক্ষ মেঘকে বলছে তার প্রিয়া যেন এখন সামনে না আসে। মেঘ যেন তাকে ভেজা বাতাসের মৃদু স্পর্শে জাগিয়ে তোলে। তার মুখে তখন মালতীর এইমাত্র ফোটা কুঁড়ির মতো আশ্বাস দেখা দিবে। আর তখন যেয়ে মেঘ ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে যক্ষের বার্তা বলবে যক্ষিণীর কাছে। মেঘ শুরু করে তাঁর পরিচয় দেয়ার মাধ্যমে। সম্বোধন করে 'অবিধবা' বলে আর নিজেকে তার পতির বন্ধু বলে আখ্যা দেয়। সে তাদের ঘটকও বটে। এরপরের শ্লোকে শেষবারের মতো যক্ষিণীর দেখা পাই আমরা। সে উৎসুক নয়নে, উচ্ছসিত মনে  মেঘের দিকে চেয়ে আছে। বার্তার শুরুর পরেই একবার শ্রোতার কথা বলা কালিদাসের নাটকীয়তা দেখানোর একটি লক্ষণ।
পরবর্তী শ্লোকে যক্ষপ্রিয়া তাঁকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় না ভোগে সে জন্য প্রথমেই অবিধবা সম্বোধন। মূল কথার আগে সে যে মারা যায় নি সেই সংবাদ মেঘ দিচ্ছে। এরপর যক্ষ কুশল জিজ্ঞাস করে। তারপর আমরা চলে আসি রামগিরিতে।
যক্ষেরও বিরহদশা অতিবাহিত হচ্ছে বলে মেঘ জানায় যক্ষিণীকে। ভাগ্যদোষে সে আজ গৃহন্তরি। প্রিয়ার বিরহে সেও কাতরে মরছে। নায়িকাকে নিয়ে কালিদাস যে কয়টি শ্লোক ব্যবহার করেছেন তার থেকে অনেক কম ব্যবহৃত হয়েছে যক্ষের শোক বর্ণনায়। তারপরও উত্তরমেঘের শেষে এসে কাব্যসুষমা আর ভাবের প্রগাঢ়তা পাঠককে বিস্মিত করতে বাধ্য। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, কাব্যটির রচয়িতা কিন্তু পুরুষ। যক্ষের সংকল্প দশার বিবরণে কালিদাস বলছেনঃ

অঙ্গেনাঙ্গং প্রতনু তনুনা গাঢ়তপ্তেন তপ্তং
সাস্রেণাশ্রুদ্রুতমবিরতোৎকণ্ঠমুৎকণ্ঠিতেন।
উষ্ণোচ্ছ্বাসং সমধিকতরোচ্ছ্বাসিনা দূরবর্তী
                            সঙ্কল্পৈস্তৈর্বিশতি বিধিনা বৈরিণা রুদ্ধমার্গঃ।।     (শ্লোক ১০৫)

এরপর বিরহিত খেদোক্তি করে যক্ষ। যেই প্রেমিক আগে প্রেমিকার মুখের ছোঁয়া পাবে বলে যে কথা সবার সামনে বলা যায় তাও কানে কানে বলতো, সে-ই আজ এত দূরে যে আমার (মেঘ) মুখ দিয়ে তার কথা শোনাতে হয়।

শব্দাখ্যেয়ঃ যদপি কিল তে যঃ সখীনাং পুরস্তাৎ
কর্ণে লোলঃ কথয়িতুমভূদাননস্পর্শলোভাৎ।
সোহতিক্রান্তঃ শ্রবণবিষয়ং লোচনাভ্যামদৃশ্য-
                          ত্বামুৎকণ্ঠাবিরচিতপদং মন্মুখেনেদমাহ।।     (শ্লোক ১০৬)

শ্লোক ১০৭ এ বিরহের হাহাকারটা অন্যরকম। রীতির মধ্যে থেকে কালিদাস এক অপূর্ব ভাবনার সঞ্চার করছেন। এখানে যক্ষ তাঁর প্রিয়ার তুলনা করার জন্য তুলনীয় বস্তু খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সে আংশিক আকারে পাচ্ছে। তাঁর আক্ষেপ কেন সে একসাথে সবকিছু পাচ্ছে না। শ্লোকটি হলঃ

শ্যামাস্বঙ্গং চকিতহরিণীপ্রেক্ষণে দৃষ্টিপাতং
বক্ত্রচ্ছায়াং শশিনি শিখিনাং বর্হভারেষু কেশান্।
উৎপশ্যামি প্রতনুষু নদীবীচিষু ভ্রূবিলাসান্
                       হন্তৈকস্মিন্ ক্বচিদপি ন তে চণ্ডি সাদ্র্শ্যমস্তি।।     (শ্লোক ১০৭)

"দেখি প্রিয়ঙ্গুতে তোমার তনুলতা, বদন বিম্বিত চন্দ্রে,
ময়ূরপুচ্ছের পুঞ্জে কেশভার, চকিত হরিণীতে ঈক্ষণ,
শীর্ণ তটিনীর ঢেউয়ের ভঙ্গিতে তোমার বঙ্কিম ভ্রূবিলাস-
                         কিন্তু হায়, নেই তোমার উপমান কোথাও একযোগে, চণ্ডী!" (বুদ্ধদেব বসু)

এরপরে সে আরো বিরহের উৎসঙ্গ দিতে থাকে। কেমন করে রামগিরিতে পাথরের গায়ে যক্ষপ্রিয়াকে সে আঁকে। যদিও বা সে সেই ছবির পায়ে নিজেকে সঁপে দুঃখ ভোলাতে যায় কিন্তু চোখের বর্ষণ তাঁর দৃষ্টিই ঝাপসা করে দেয়। স্বপ্নে যক্ষিণীর দেখা পেয়ে যক্ষ হাত বাড়িয়ে দেয় আনমনে। কিন্তু সে হাত প্রক্ষিপ্ত হয় শূন্যে আর এ দেখে বনের দেবতারা মুক্তোর মতো চোখের পানি ফেলে। করুণরস আরো ঘনীভূত হয় যখন যক্ষ বলে উঠে কিরকম করে তুষারগিরি হতে ধেয়ে আসা বাতাস পেলে সে বাতাসেই আলিঙ্গন করে বসে। কারণ সে ভাবে এই বাতাস তাঁর প্রিয়ার শরীর ছুঁয়ে এসেছেঃ

আলিঙ্গ্যন্তে গুণবতি ময়া তে তুষাররাদ্রিবাতাঃ
                         পূর্বং স্পৃষ্টং যদি কিল ভবেদঙ্গমেভিস্তবেতি ।।     (শ্লোক ১১০)

যক্ষ সময়ের অবিবেচকতা নিয়েও দুঃখিত। তাঁকে দীর্ঘ রাত ও দীর্ঘ দিন পার করতে হচ্ছে। এমন সব দুর্লভ কামনা পোষণ করে যক্ষের মন কষ্টে ছেয়ে যাচ্ছে। যক্ষের বিরহ এ পর্যন্তই।
এরপরে আসে অভিনব মোড়। যক্ষ হঠাৎ ন্যাকা প্রেমিক থেকে বাস্তববাদী পুরুষ হয়ে উঠে। অমোঘ আপ্তবাক্য উচ্চারণের আগে সে যক্ষিণীকে বলে নেয়, অনেক চিন্তা করে নিজেকে সে আটকে রেখেছে এবং যক্ষপত্নীও যেন অনুরূপ করে। সে যেন হতাশায় ডুবে না যায়। কেননাঃ

কস্যাত্যন্তং সুখমুপনতং দুঃখমেকান্ততো বা
                      নীচৈর্গচ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রনেমিক্রমেণ।।    (শ্লোক ১১২)

"এমন কে বা আছে, নিত্য দুঃখ বা নিয়ত সুখ জোটে ভাগ্যে,
                      কখনো উত্থান, কখনো অবনতি, চক্রনেমি যেন মানবদশা" (বুদ্ধদেব বসু)

এরপর যক্ষ তাঁর প্রেমিকাকে আশ্বস্ত করছে। চার মাশ ধৈর্য ধরে থাকতে বলছে। বিষ্ণুর অনন্তনাগ শয্যার শেষে (মিশরীয় হোরাসের মত বিষ্ণুও বার্ষিক নিদ্রায় যান। হোরাসের ঘুমের সময় নীলনদে বন্যা হয়, আর বিষ্ণুর ক্ষেত্রে বর্ষা হয় ভারতে।) কার্তিক মাসে যক্ষের শাপমুক্তি হবে। তখন তারা শারদীয় জ্যোৎস্নারাতে মিলিত হবে। আর তাদের জমে থাকা ইচ্ছা-অভিলাষ পূরণ করবে।
শ্লোক ১১৪ অভিজ্ঞান বুঝাতে ব্যবহৃত। অর্থাৎ এই বার্তা যে যক্ষ থেকেই এসেছে ও বার্তাবাহক যে বিশ্বাসের যোগ্য তার প্রমাণস্বরূপ এমন কিছু যা কেবল বার্তার প্রেরক ও প্রাপক জানে। আলোচ্য অভিজ্ঞানটি হলঃ "একবার রাতে যখন আমরা গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম তখন হঠাৎ কেঁদে জেগে উঠলে তুমি। আমার বারংবার প্রশ্নে মনে-মনে হেসে বললে ধূর্ত প্রেমিক তুমি! স্বপ্নে দেখলাম তুমি অন্য নারীর সাথে রমণে রত" অর্থাৎ সে হাসি লুকাতে চাচ্ছে একারণে যে তার গলা জড়িয়ে ধরে যক্ষ অন্যত্র যেতে পারবে না। তাই স্বস্তির হাসি লুকিয়ে নীরব সুখ ও লজ্জা যক্ষিণীর। শ্লোকেঃ

ভূয়শ্চাহ ত্বমপি শয়নে কণ্ঠলগ্না পুরা মে
নিদ্রাং গত্বা কিমপি রুদতী সস্বরং বিপ্রবুদ্ধা।
সান্তর্হাসং কথিতমসকৃৎ পৃচ্ছতশ্চ ত্বয়া মে
                      দ্রৃষ্টঃ স্বপ্নে কিতব রময়ন্ কামপি ত্বং ময়েতি।।    (শ্লোক ১১৪)

অতএব এই কথার মাধ্যমেই চিনে নিবে যক্ষপ্রিয়া তার প্রেমিককে। যক্ষ এও বলে দিচ্ছে সে যেন যক্ষ অন্যগামী হয়ে গেছে সেই দুশ্চিন্তা না করে। বিরহে আমার প্রেম কমে গেছে, এমনটা ভেবো না। যক্ষের ধারণা এতে মহৎ প্রেম আরো পরিপূর্ণতা পায়। 
এরপর যক্ষ মেঘকে বলে বার্তা দেয়া শেষে সে যেন ফিরে আসে যক্ষিণীর চিঠি নিয়ে। সাথে যক্ষিণী থেকেও অভিজ্ঞান আনার কথা বলে দেয় যক্ষ। যাতে সে বুঝতে পারে মেঘ তার কাজে অবহেলা করেনি। 

এই ধারণাটি যদিও কালিদাসের নিজস্ব নয়। বাল্মীকি রামায়ণে একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। সুন্দরকাণ্ডে সীতার কাছে রাম হনুমানকে পাঠায়। অভিজ্ঞান হিসেবে রাম পাঠান তাঁর নামাঙ্কিত একটি আংটি ও সীতা হনুমানকে দিয়ে বার্তার প্রতি উত্তর পাঠানোর সময় বনবাসে থাকাকালীন একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ও চূড়ামণি পাঠান। 
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই, এই মেঘদূত আদতে সুন্দরকাণ্ডের সেই বার্তা আদান-প্রদানের খণ্ডিত অংশ। যেখানে রামগিরিতে বসে থাকা যক্ষ হলো রাম, আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ হলো হনুমান, আর অলকায় থাকা যক্ষিণী হলো সীতা। যদিও মেঘদূতে হনুমানের মতো প্রত্যুত্তর পাঠানো পর্যন্ত কাব্য বিস্তৃত নয়। তারপরও ভাবের সঞ্চারে কালিদাস অনেকাংশে বাল্মীকির কাছে ঋণী যার বিশদ আলোচনা বুদ্ধবাবুর প্রবন্ধে আছে।

এরপর যক্ষ মেঘকে কিঞ্চিৎ চাটুবাক্য উৎসর্গ করে। পুরো কাহিনী বলার পর সে মেঘকে জিগ্যেস করে সে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক কিনা। আবার সাথে সাথেই বলে দেয়, তুমি নিরুত্তর থাকলেও বুঝে নিব তুমি আমার কথা শুনবে। কারণ, তুমি সেই মেঘ যে চাতক পাখি চাইলেই পানি দিয়ে দেয়। তোমার জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যই প্রার্থীর মনোবাঞ্ছাপূরণ। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যক্ষ এখানে স্পষ্টতই বুঝতে পারছে, সে এতক্ষণ উদ্ভট বাক্যবিনিময় করেছে মেঘের সাথে। তারপরও বিরহক্লিষ্ট যক্ষের কাছে এটাই বাস্তবতা, এটাই সান্ত্বনাদায়ী। শ্লোকটি এরূপঃ
কচ্চিৎ সৌম্য ব্যবসিতমিদং বন্ধুকৃত্যং ত্বয়া মে
প্রত্যাদেশান্ন খলু ভবতো ধীরতাং কল্পয়ামি।
নিঃশব্দোহপি প্রদিশসি জলং যাচিতশ্চাতকেভ্যঃ
                     প্রত্যুক্তং হি প্রণয়িষু সতামীপ্সিতার্থক্রিয়ৈব।।     (শ্লোক ১১৭)

শেষ শ্লোকে যক্ষ আরো স্পষ্ট করে বলছে এটি তাঁর অনুচিত যাচনা মেঘের প্রতি। তাও সে তাঁর এই আবদারটি রাখুক এই তাঁর প্রার্থনা। আর শেষাংশে সে মেঘ এবং সকল পাঠক-পাঠিকার প্রতি শুভকামনা জানাচ্ছে এই বলে যেঃ "বিদ্যুৎ-বিচ্ছেদ জীবনে না ঘটুক" (অনুবাদে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত) অর্থাৎ মেঘের প্রিয়া বিদ্যুৎ এবং সকলের ভালোবাসার মানুষরূপী বিদ্যুতের সাথে যেন কারো বিচ্ছেদ না ঘটে। এ শান্তির আশিস দিয়ে শেষ হয় মেঘদূতঃ
          ক্ষণমপি চ তে বিদ্যুতা বিপ্রয়োগঃ।।     (শ্লোক ১১৮)

আরেকটি বইয়ে এর সামান্য বিস্তৃত পাঠ পাওয়া যায় যে, যক্ষের এই বাণী শুনে কুবেরের রাগ ঠাণ্ডা হয় এবং তিনি যক্ষকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দেন। যক্ষ এরপর তাঁর যক্ষিণীকে নিয়ে অশোকচিত্তে চিরকাল সুখে-সম্ভোগে আর সন্নিপাতে কাটাতে লাগলো। যদিও এ অংশ প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে হয়। 

ইতি শ্রীমহাকবিকালিদাসক্বতং মেঘদূতং সমাপ্তম্‌

এবার একটি মজার পর্যবেক্ষন নিয়ে লিখি। 'মেঘদূত' কাব্যটিকে আধুনিক কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এ এক ইউজার বা ডিভাইস থেকে অন্য ইউজার বা ডিভাইসে কোন মেসেজ বা তথ্য পাঠানোর জন্য প্রটোকলের সাথে তুলনা করা যায়। 
কিরকম? 
বলি!
প্রথমেই যক্ষ মেঘের গন্তব্য বলে দিচ্ছে ও বার্তাসহ পথ-পরিক্রমা সুসংহত করে নিচ্ছে। (Packet Formation)
যক্ষ মেঘকে কোন্‌ কোন্‌ এলাকা বা শহরের উপর দিয়ে যাওয়া লাগবে তা বলে দিচ্ছে। সাথে এটাও বলে দিচ্ছে ওখানে কি কি দেখা যাবে। (Relay Network Node Establishment)
অলকায় পৌঁছে যাবার পর যক্ষপ্রিয়ার কাছে যেতে সুনির্দিষ্ট ঠিকানা ও বাড়ির চেহারা-লক্ষণ বলে দিচ্ছে। (IP Address)
এরপর যক্ষপ্রিয়াকে বার্তা দেবার সময় প্রথমেই মেঘ তার পরিচয় ও বার্তাপ্রেরকের পরিচয় দিয়ে নিচ্ছে, যার পড়ে মূল বার্তাপাঠ শুরু হয়। (Main Message)
সবশেষে একটি অভিজ্ঞান ঘোষণা করে মেঘ, মানে এমন একটি কথা যা শুধু প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া কারো জানার কথা না। (Private Key Authentication)
শুধু একটাই খুঁত, TCP/IP এর মতো এখানে বার্তা যে ঠিকমতো পৌঁছেছে তার কোন সংবাদ প্রেরক (যক্ষ) পায়নি।
আরো একটি মজার বিষয় হল, মেঘকে এই বার্তাবাহক হিসেবে পাঠানোর জন্য যে তৈলমর্দন যক্ষকে করা হয়েছে তা সেই সময়কার আমলাতান্ত্রিকতার একটি উদাহরণ বলা যেতে পারে। প্রথমেই মেঘকে উচ্চবংশীয় ও রাজকীয় অভিবাদন জানিয়ে যক্ষ একে একে তাকে বলতে থাকে, এই বার্তাটি পৌঁছে দিলে মেঘের কি লাভ হবে। কার সঙ্গ পাবে, কার দৃষ্টি পেয়ে জীবন ধন্য হবে, কোন এলাকায় কি দেখে মেঘের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হবে - এসবের বিশদ বিবরণ আছে এর মধ্যে।

কালিদাসের মেঘদূতের প্রভাব কি রকম সুদূরপ্রসারী তার নমুনা ধরা যায় এ থেকে যে, এই কাব্যের অনেকাংশ অনুমান করে সংযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ কালিদাসের লেখার অনুকরণে নতুন কিছু শ্লোক যোগ করা হয়েছে। আবার এই কাব্যের অনুকরণে ৫০এরও বেশি দূতকাব্য (পবনদূত, হংসদূত, ভ্রমরদূত, কোকিলদূত) রচিত হয়েছিল কালিদাসের পরবর্তী সময়ে। এ থেকে এই কাব্যের জনপ্রিয়তা বুঝা যায় বলে মন্তব্য করেছেন ধীরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। এছাড়াও সেই চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত এই কাব্য থেকে প্রভাবিত হয়ে আজো বহু সাহিত্যে ও চিত্রকলায় মেঘদূতের প্রসঙ্গ টেনে আনা এর কালোত্তীর্ণ গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় দেয়। ভারতের CBSE পাঠ্যক্রমে চারুকলার দ্বাদশ শ্রেণীতে মেঘদূত অন্তর্ভুক্ত।
এখন মেঘদূতের কাহিনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু চিত্রকলার উদাহরণ দিচ্ছি। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ ছবিই চিত্রকলার "Bengal School of Art" ঘরানার। এই আন্দোলন ব্রিটিশ ভারতে শুরু হয় ও তুঙ্গে উঠে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। যদিও বাস্তববাদ শুরু হবার পর এই ধারা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, তারপরও এই শতকে এর কদর আবার বাড়ছে। এই ধারার স্পষ্ট অভিব্যক্তিসম্পন্ন তেল ও জল রঙের ব্যবহার ইউরোপীয়দেরকেও মুগ্ধ করেছে।

The banished Yaksha by Abanindranath Tagore
Source: The Fugitive Saint

Yakshini of Meghdoot by Alka Trivedi
Source: Indian Art Ideas

Yakshini of Meghdoot by Alka Trivedi (Verse 90)
Source: 
Indian Art Ideas

Meghdoot by Lalit Kumar Jain
Source: 
Artflakes

Braid of Yakshi by Charu Roy (Verse 95)
Source: Geocities Meghdoot


The helper Stroks by Purna Chakravarty (Verse 9)
Source: Geocitites Meghdoot
The awaiting Yakshini by Purna Chakravarty (Verse 10)
Source: Geocities Meghdoot 


Flower Girls by Charu Roy (Verse 27)
Source: Geocitites Meghdoot

Village women gazing at cloud by Purna Chakravarty (Verse 16)
Source: Geocities Meghdoot

Yaksha venerating Kartik by Purna Chakravarty (Verse 44)
Source: Geocities Meghdoot

Shame-struck Alka woman getting hold of garments by Charu Roy
Source: Geocities Meghdoot

The lake of Yaksha House by Purna Chakravarty
Source: Geocitites Meghdoot

Yaksha garden's dancing peacock by Charu Roy (Verse )
Source: Geocitites Meghdoot

এই ছবিগুলো দেখেই বলা যাচ্ছে, এই একটি কাব্য কি পরিমাণ শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ করেছে রঙ আর তুলি হাতে তুলে নিতে। বেশির ভাগ ছবিই নরেন্দ্র দেবের অনূদিত মেঘদূত থেকে নেয়া। বুদ্ধদেব বসুর টা পড়া হলেও নরেনবাবুরটাও সংগ্রহে রাখার ইচ্ছা পোষণ করছি।
কাব্যটি ইংরেজিসহ ভারতীয় প্রায় সকল আঞ্চলিক ভাষায় ও ইউরোপীয় কিছু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। যেগুলো প্রশংসিতও হয়েছে জ্ঞানীমহলে।

এই কাব্যের কদর ১৪০০ বছরেও একইরকম আছে। সেই থেকেই এর শিল্পগুণ বুঝা যায়। কালিদাসের কিছু ক্ষেত্রে উপমার আতিশয্য বাদ দিলে পুরো রচনাতে এক অদ্ভুত সুন্দর আস্বাদন পাওয়া যায়। বারবার পড়া যায় এমন কবিতা এটি-কোন সন্দেহ নাই এতে। ঈষৎ দীর্ঘ, কিন্তু উপভোগ্য। ব্যাপক কামাতুর, কিন্তু বিনোদী। কিছু জায়গায় একঘেয়ে, কিন্তু ঠিক এরপরেই পূর্ণ জোশে প্রত্যাবর্তন। একটি কথা অনায়াসে বলা যায়, এই কবিতা পড়ে কারো বোর্‌ড হবার কথা না। যদি কেউ হয়, তবে সে কবিতা ভালোবাসে না, তার শিল্পের কদর করার ক্ষমতা খুব সংকীর্ণ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। বুদ্ধবাবু যেমন বলেন, 'এই কবিতার ভালো লাগার জায়গা এর ভাবনা নয়, বরং এর গতি।'
বয়সসীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়েছে আমার কাছে এটা পড়তে যেয়ে। আঠার বছরে দৈহিক পূর্ণতা এলেও আমার মতে মানসিক সম্পূর্ণতা আসতে আরো কিছু সময় লাগে। কেননা মেঘদূতের বিষয়বস্তুর উত্থাপন সহজভাবে নিতে গেলে শুধু শব্দের মানে বুঝা ও জানা আবশ্যক নয়। সাথে মানসিক একটা পরিপক্বতা অত্যন্ত জরুরি। কাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখা উচিত, কবির মননে কি ছিল, সে দৃষ্টিভঙ্গি যে ভিন্ন সেটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নিজের একটি ধারণা নেয়া উচিত। সাথে নিজের সাথে একটা আপোষে পৌঁছানো যে নিজের মতের বাইরেও নানা মত পৃথিবীতে থাকতে পারে। এবং সব ধরণের মতবাদের সমর্থক থাকার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে। সে যুক্তি না জেনে অন্ধের মত নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই সবকিছুকে ছুঁড়ে দেয়ার মনোভাব পরিহার করে সকল চিন্তার সহাবস্থান যে স্বাভাবিক এটা মেনে নেবার মত ধীশক্তি অর্জন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ২০ বছরই আমার মতে এই সাহিত্য উপভোগ করার নিম্নসীমা।
অপূর্ব এই শিল্পকর্ম (শিল্পই বলা চলে, এটি কেবল একটি কবিতা নয়) সকল সাহিত্যপ্রেমীরই একবার হলেও চেখে দেখা উচিত। তাদের উচিত মেঘদূতের শীতল জলে একবার হলেও স্নান করে নেয়া। একবার হলেও যক্ষের চোখে ভারতটাকে দেখা।  একবার হলেও এক কামাতুর প্রেমিক-প্রেমিকার মনে দরজা খুলে উঁকি দেয়া। একবার হলেও আবেগের সূক্ষ্ম কিনারাগুলো ছুঁয়ে নতুন করে প্রণয়কে দেখা। একবার হলেও কালিদাসের কলমে গঙ্গার কলকল ধ্বনি শোনা, বর্ষার ফুলের গন্ধ নেয়া, পাখপাখালির গান শুনতে কান পাতা, চোখ জুড়িয়ে যাওয়া নদী-পাহাড় ও প্রাণিগুলোকে দেখা এবং কল্পনার রাজ্যে নিজের মত করে স্বর্গপুরী তৈরি করে নেয়া। তাহলেই কালিদাস সার্থক। পাঠক বা পাঠিকা হিসেবে আমরা সার্থক।

বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ পড়ার দরুন এহেন উপলব্ধি ও বাক্যব্যয় সম্ভব হয়েছে। তাই, এই অসামান্য প্রতিভাবান সব্যসাচীর (স্বঘোষিত ও পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় হাতের মাজেযা দেখানো নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত) প্রতি সম্মান জ্ঞাপনে আলাদা একটি পোস্ট যোগ করছি। সেখানে তাঁর মেঘদূতের ভূমিকায় লেখা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধের সারকথা লিখার চেষ্টা করেছি। সমালোচনা নয়, বরং সংক্ষেপিত ও সহজতর পাঠ বলাই উপযুক্ত।
পোস্টটি এখানে ক্লিক করে পাওয়া যাবে।

Comments

Post a Comment

The Most Hits