ভূমিকার সারকথাঃ সংস্কৃত কবিতা ও 'মেঘদূত' (বুদ্ধদেব বসু)

"স্মৃতি থাকে। শেষ পর্যন্ত শুধু স্মৃতিই থাকে, আর কিছুই থাকে না।"
-বুদ্ধদেব বসু 

Buddhadeb Bose (1908-1974) at Young age
Source: The Daily Star

বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খুঁটি এবং তৎকালীন তীক্ষ্ণ সাহিত্য সমালোচক। রবীন্দ্রনাথের পর তাঁকেই খুব জোর সহকারে সব্যসাচী লেখক বলা যায়। লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, অনুবাদ। তাঁর ঝুলি বেশ ভারীই বলা চলে। তাঁকে পঞ্চপাণ্ডবের কাণ্ডারী বললে অত্যুক্তি হবে না। পঞ্চপাণ্ডব হল যারা রবি ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে বিষয় নির্বাচনে, ভাষার ব্যবহারে ও ব্যঞ্জনা প্রকাশে নতুন রীতি ও আধুনিকতা নিয়ে আসেন তাদের একটি অভিজাত দল। বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তারা বিশের দশকে যে সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেন তার মূলকথা ছিল- রবি ঠাকুরকে বাংলা বড্ড বেশি অনুকরণ করে। ফলে মৌলিকতার স্ফুরণ হচ্ছে না। বুদ্ধবাবুর হাত ধরে প্রগতি ও কবিতা  এর মত যুগান্তকারী পত্রিকা বাংলায় বের হয় যা সাহিত্যের স্রোত পাল্টে দেয়। জীবনানন্দকে তিনি সর্বদাই উৎসাহিত করে গেছেন। তাঁর লেখাগুলো কবিতা ও প্রগতিতে নিয়মিত ছাপা হতো। পাশাপাশি কবিগুরুর সমালোচনা করতেও পিছপা হতেন না সেসময়কার নাদান যুবক বুদ্ধদেব। তাঁর ঝটা দেখা যায় বহু লেখনীতে। আবার রবিগুরুর বিস্ময়কর প্রতিভাকে যথাযথ সম্মান দিতেও পিছপা হননি এই সমালোচক। বুদ্ধদেবের মস্তিষ্কের আসল ছটা দেখা যায় কবিতায় ও অনুবাদে। বোদেলেয়ার (ফ্রেঞ্চ), হোল্ডারলিন, রিলকের (জার্মান) মত আধুনিক মতধারার রোমান্টিক কবিদের অনুবাদ বাংলায় করে পাঠকদের নতুন ভুবনের স্বাদ দিয়েছেন। আবার ক্লাসিক মেঘদূতের বাংলায় লিখার ফলে বহু মানুষের পিপাসা মিটিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ কাব্যটির মূল ভাব ধরতে যতটা না সাহায্য করে, তার চেয়ে বেশি কাজের শ্লোক ধরে ধরে বুদ্ধবাবুর টীকা সংযোজন এবং অনুবাদের আগে সংস্কৃত কবিতা নিয়ে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ একটি প্রবন্ধ। কুমিল্লার বুদ্ধদেব বসু তাঁর রচনায় যে প্রগাঢ় জ্ঞানের, পর্যবেক্ষণের ও আন্তরিকতার ঝাঁপি খুলে আমাদের সামনে পেশ করেছেন, তা নিয়ে কিছু বাক্যব্যয় না হলে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা হয় বৈকি!
সাত অনুচ্ছেদে তিনি ধীরে ধীরে ব্যক্ত করেছেন আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান এবং তার তুলনায় সংস্কৃতের তৎকালীন এবং বর্তমান অবস্থা। সাহিত্য ও রূপক নিয়েও সুবিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।

১) সংস্কৃত ভাষা থেকে আমরা ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। হয়ে গিয়েছি সত্যি বলতে। ধীরে ধীরে বৈদেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত থাকার ফলে এই ভাষার দরদ যেমন কমেছে, সাথে সাথে এ ভাষা হতে উদ্ভূত হয়েছে বহু ভাষা যেগুলো আধুনিক বলে এখনো ব্যবহৃত (হিন্দি, বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, উড়িয়া, অসমিয়া)। পাশাপাশি যান্ত্রিক যুগে প্রবেশের দরুন এত নিত্য নতুন বিষয়-জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে যে সংস্কৃতের মত একটি অপ্রচলিত ভাষা নিয়ে সময় ব্যয় করা অর্থহীন বলা যেতেই পারে। আমাদের পশ্চিমের আকর্ষন দুর্বার, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের আচার, রীতি, ভাষা ব্যবহার - হরহামেশাই আমরা কায়মনোবাক্যে অনুসরনীয় ধরে নেই এবং সেই মোতাবেক চলার চেষ্টা করি। দোষের কিছু নেই হয়তো এতে, আবার ভাষার শেকড় উপেক্ষা করে ফল খেয়ে যাওয়াটাও বোধ করি খুব বেশি দিনের জন্য সম্ভব না। যার দরুন ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু দেশি শব্দ হারাতে বসেছি। যেমনঃ আসন, ধন্যবাদ (সত্যিকার অর্থেই এই শব্দ আমরা এখন কত কম ব্যবহার করি তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে), কুড়ি, ডাগর, ডাহা প্রভৃতি। একইসাথে এটাও আমাদের জানা উচিত যে, এই সংস্কৃত ভাষার আবিষ্কার হয়েছিল দেখেই তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান (Philology) একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানের শাখা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। এলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ধারণা। এসকল কিছু এসেছে ব্রিটিশদের সংস্কৃত নিয়ে গবেষণা করার ফলে। তারা চেয়েছিল তাদের উপনিবেশ সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ধারণা নিতে। যার ফলে তাদের সমাজ ব্যবস্থা, গাঠনিক বুনন সম্পর্কে শাসকদের ধারণা স্পষ্ট হয়। যার ফলে, সংস্কৃত ভাষার কীর্তিগুলো নিছক এ এলাকার ফ্লোরা, ফনা আর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য জানার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তাই সংস্কৃতের স্থান অতি উচ্চ স্থানে নেই। একই কারনে, সাহিত্যের একজন ছাত্র যতটা আগ্রহ নিয়ে Faust, Taming of the Shrew, Hamlet, Oedipus, Inferno পড়ে, সেই আগ্রহটা শকুন্তলা, কুমারসম্ভব বা মেঘদূতে থাকে না। তাই হুইটম্যানের 'প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া', টি এস এলিয়টের 'দি ওয়েস্ট ল্যান্ড', 'ফোর কোয়ার্টেটস', গ্যেটের 'শকুন্তলা প্রশস্তি' বা রাল্‌ফ ওয়াল্ডো এমারসনের 'ব্রহ্ম' - কেবল বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। সামগ্রিক চিত্র নয়। ব্রিটিশরা উপনিবেশগুলোতে যে 'বোঝা' বহন করার কথা বলতঃ শিক্ষিত করা, বর্বরতা থেকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসা, যোগাযোগ উন্নত করা - এসবের মধ্যে সংস্কৃত উদ্ধারও ছিল।

২) সংস্কৃত ভাষার এতটা দূরে যাবার আরেকটি কারণ হল, ভাষা ও ভাষাটির ব্যাকরণের কিছু বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতের একটা সুবিধা হলঃ এ ভাষার শব্দ তৈরির ক্ষমতা অনেক। আবার একটা অসুবিধা হলঃ এ ভাষার শব্দ তৈরির ক্ষমতা অনেক। উদ্ভট শোনাতে পারে। কিন্তু একটু খোলাসা করলেই বুঝা যাবে। বাংলায় আমরা এখন 'মহাজাতি-সদন', 'প্রিয়ার ভবন', 'ব্যবসানিকেতন' বললেও 'হরি পালের সদন' হয়তো বলবো না। না বলে দিলেও সদন, ভবন, নিকেতনের সাথে আমাদের সম্মানের, প্রেমের ও প্রাতিষ্ঠানিকতার একটি ইঙ্গিত এসে পড়েছে। আবার নারী প্রসঙ্গেও যুবতী, ভার্যা, মহিলা, বধূ, ললনা, রমণী, বনিতা, কামিনী, স্ত্রী ইত্যাদি প্রতিটা শব্দেরই আলাদা আলাদা ভাব আছে, যা বাংলায় বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতে এ ব্যাপারটাই অনুপস্থিত। সংস্কৃতে সমার্থক শব্দ অনেক। আবার এই সমার্থক শব্দগুলো আদতে একে অপরের জায়গায় ইচ্ছামত অর্থের পরিবর্তন না করে বসে যেতে পারে। আবার যেকোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে শব্দ সন্ধি-সমাস দিয়ে জোড়া লাগিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করাও কঠিন কিছু না। ফলে, কাব্যে শব্দযোজনা বাড়ে, আমরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন শব্দের আবেশে মুগ্ধ হই কিন্তু শব্দের জোর কমে যায়। যেমনঃ আমাদের আধুনিকতম কবি জীবনানন্দ দাশ 'সুদর্শনা' কবিতায় যখন বলেন-
"একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।"

তখন এটুকু আমরা বুঝি সুদর্শনা বলতে এখানে যে 'মহিলা'র কথা বলা হচ্ছে - তিনি নগরবাসিন্দা ভদ্রমহিলা, তরুণী নন। আবার বেদনার কড়াঘাত প্রকাশ করতে কিন্নরকণ্ঠ ও অমৃতসূর্যের ব্যবহার যে আলাদা দ্যোতনা কবিতায় যোগ করেছে, তা সংস্কৃতে সম্ভব হতো না। সংস্কৃতের আরেকটি ঝামেলা হল, বাক্যের মধ্যে পদের বিন্যাস, এমনকি বাক্য বা পদ্যে পঙক্তিরই অস্তিত্বহীনতা। তাই, সংস্কৃতে আমরা যদি বলিঃ "শান্তি নাটোরের দুদণ্ড আমায় সেন বনলতা দিয়েছিল" তাতে অর্থের কোন ক্ষতি হয় না। 

৩) তৃতীয় কারণ হিসেবে বুদ্ধবাবু দেখিয়েছেন, সংস্কৃতের কৃত্রিময়তাকে। যেখানে আধুনিক কবিতা তাঁর বিষয়ে, বিন্যাসে, পদে সাধারণ হবার অভিনয় করে, সংস্কৃত যেন সেই কৃত্রিমতাটাকে সগর্বে ঝান্ডা হিসেবে ব্যবহার করে। তাইতো বর্ণনার আধিক্যে, অলংকারের ডামাডোলে প্রায়ই সংস্কৃত কবিতা অনেকখানি শ্রুতিসর্বস্ব হয়ে পড়ে। এই সংস্কৃত ভাষাটি কিন্তু আদতে আমাদের এই এলাকার স্থানীয় ভাষা নয়। ককেশীয় আর্যদের নিয়ে আসা ভাষা হল এই সংস্কৃত। আমাদের সত্যিকারের আদি ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যৎসামান্য কিছু শব্দ হয়তো বর্তমানের কয়েকটি ভাষায় টিকে আছে (দ্রাবিদীয় ভাষাগুলো (তামিল, তেলুগু, মালায়ালাম) এখানে উল্লেখযোগ্য)। 
কিন্তু এই সংস্কৃত ভাষারই কেবল নমুনা পাওয়া যাচ্ছে, তাই এর সার উপভোগই শ্রেয়। এবং এতে সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো সত্যিকার অর্থেই বাহ্‌বা পাওয়ার দাবি রাখে বলেই T. S. Eliot ভগ্‌বদ গীতা পাঠের পর বলেছেন,

"The Gita is the second greatest philosophical poem in my experience, first being The Divine Comedy."

তাইতো এত কৃত্রিমতা সত্ত্বেও এই ভাষাতে লিখা হয়েছে কিছু অমর গাঁথা। যা শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়, উত্তম সাহিত্যরূপেও পাঠযোগ্য। গীতার বিশ্বরূপদর্শন, রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে গঙ্গার ও কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বর্ষার বর্ণনায় আমরা শিহরিত হই। ভাষার আলেখ্যে, ভাষার সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হই। সেই সাথে এও কিঞ্চিৎ সত্য যে, রোমান্টিক সাহিত্যের উদাহরণ সেই সময়ে ধর্মগ্রন্থ ছাড়া দুর্লভ।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন। কলা বা আর্টের রূপান্তর। মধ্যযুগে ইউরোপে যখন রেনেসাঁস সূচিত হল এবং তাঁর আগে মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সভ্যতায়, প্রথমদিকের নিদর্শন দেখে মনে হয় ধর্মের প্রয়োজনে শিল্প স্ফূরিত হয়েছে। চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, সুরম্য অট্টালিকা - এসব ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। প্রকৃত রোমান্টিসিজম আমরা পাই ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিশানের পর থেকে। আর আর্ট স্রেফ কলা হওয়া শুরু করে রেনেসাঁসের সময় থেকে। কেননা তখন আর্ট ধর্মের মুঠো থেকে বের হয় আসতে শুরু করে এবং স্বতন্ত্রভাবে ঘোষণা করল যেঃ "আমি কোন কাজে লাগি না। কিন্তু আমি আছি"। আর্টের বর্তমান রূপ কিন্তু তারই পরিপক্ক চেহারা। কলার সংখ্যা ৬৪টি বলা হয়। মানে ৬৪ রকমের আর্টফর্ম চর্চিত হয় বিশ্বে। এতেই এর ব্যাপকতা অনুধাবন করা যায়।
পাশাপাশি, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেক অঞ্চলে একেকরকম - এতো বহু আগে প্রতিষ্ঠিত সত্য। গ্রিক শিল্প যখনই মানবদেহের সৌন্দর্য নিয়ে কাজ করেছে তখনই দেখা গেছে নগ্নতা এসেছে। আপাদমস্তক নগ্নতাতেই ফুটে উঠেছে সৌন্দর্যের ছটা। যদিও হেলেনিস্টিক প্রথানুযায়ী নিম্নাঙ্গ সর্বদাই কাপড় বা হাত দ্বারা ঢাকা থাকতো। আর ভারতীয় শিল্পেও নগ্নতা, যৌনতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বেশিই ছিল। কিন্তু সে নগ্নতায় কোন না কোন অলংকার থাকতই। ভারতীয় আদি শিল্পীদের মতে, ভূষণহীন সৌন্দর্য অসম্ভব। তাই দেখা গেছে নগ্নভাবের কোন ভাস্কর্যেও কানের দুল, নথ, কোমরবন্ধনী বিছু, হাতের অলংকার বা গলার হার - কিছু না কিছু ব্যবহৃত হয়েছে। তাই বতিচেল্লীর বার্থ অফ ভিনাস  যেমন এক অর্থে সুন্দর,  ঠিক তেমনি কোনার্কের অপ্সরা ও অজন্তার মারকন্যার সৌন্দর্যও বেশি বৈ কম নয়। 
সৌন্দর্যবিচারের এই স্ট্যান্ডার্ডটিই কৃত্রিমতাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। ভাষার ব্যবহারে সংযম বা বলিহারি - যেটাই বলি না কেন এর মাধ্যমে রচনাকারীর বৈদগ্ধ যেমন প্রকাশ পায় ঠিক তেমনি ভাষার সুষমতা আমাদের সামনে আরো প্রকট হয়।
কৃত্রিমতার আরেকটি অসাধারণ উদাহরণ দিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বাংলার ঘুম-পাড়ানি ছড়াটির বিভিন্ন প্রকরণ প্রচলিত আছে। যেমনঃ

ঘুম-পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি যেয়ো,

বাটা ভরে পান দেব গাল পুরে খেয়ো


অথবা

ঘুম-পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো,

খাট নেই, পালঙ্ক নেই, চোখ পেতে বসো।

এখানে প্রথম ভার্শনটিতে নিছক সুগৃহিণী ও সুমাতা যে কিনা উত্তম পদ্যকার তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। যিনি ঘুমদেবীকে প্রতিবেশী হিসেবে কল্পনা করে সাধারণ আপ্যায়নের প্রলোভন দেখাচ্ছেন। কিন্তু দ্বিতীয়টাতে আমরা একজন কবির দেখা পাই, যিনি এক অলৌকিক দেবীকে ডাকছেন এবং তাকে বসার জন্য নিজের সন্তানের চোখকে নিবেদন করছেন। এই যুক্তিহীনতাটাই কবিতার প্রাণ। এখানে ভাষার চেয়ে কল্পনাশক্তির প্রাধান্য বেশি। তাই সংস্কৃতে এমন ব্যবহার কল্পনা করা যায় না। সবকিছু যেন ছকে বাঁধা। বড্ড বেশি যান্ত্রিক।
আর তাই তো প্রেমিকার পরিচয় দেবার জন্য কালিদাস যেমন তাঁর দৈহিক সৌন্দর্যের বয়ান করেন, একজন আধুনিক কবি তাঁর ভাবনাকে কলমে ছড়িয়ে দিয়ে কাগজে বেঁধে ফেলেন।

সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো -- আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,
    আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কালিদাস যখন তাঁর তন্বী শ্যামা শিখরিদশনার দেহের একেক অংশের মোহ বর্ণনা করেন রতির অনুষঙ্গে তখন সেদিন দুলেছিনুর এই চরণ কয়টি শোনার সাথে সাথে আমরা বিনা ক্লেশে নায়িকার মায়াময় রূপ ও বক্তার বিরহ টের পাই। আমরা হই কবির অনুভবের অংশভাগী। এখানে এসেই অলংকারের শৃংখলার মুক্তি। ভাষার মুক্তি। সাহিত্যের মুক্তি।

৪) মেঘদূতের মূল আবেদন এর সমগ্রতায়। আর মূল আকর্ষন এর গতিতে। আর তাই পুরো কলেবর পড়ে শেষ করা যায় এক বসায়। সাথে কালিদাসের ক্লাসিক উপমা-রূপকের ছড়াছড়ি তো আছেই। কালিদাস খুব যে প্রগতিশীল ছিলেন তা সম্পূর্ণভাবে বলা যায় না। তাঁর মধ্যে ঐতিহ্যবোধ ছিল প্রবল। তিনি জানতেন তাঁর সৃষ্টির জন্য দীর্ঘ কবিবংশের কাছে তিনি কতটা ঋণী। এবং বাল্মীকি হতে বহু কিছুই ধার করেছেন। রামগিরিতে অবস্থান, হনুমানের মত মেঘকে দিয়ে প্রিয়ার কাছে বার্তা দেয়া। এছাড়াও বর্ষার সাথে বিরহের সম্মিলন তো বাল্মীকিরই প্রথম কীর্তি। সেসময় কাজে ঘরের বাইরে থাকা পতি ঘরে ফিরতো বর্ষার আগে। কোনবার বর্ষা শুরু হয়ে গেলে তাই পত্নীদের বিরহের অন্ত থাকতো না। 
এছাড়াও পুরো কলেবর জুড়ে ভারতবর্ষের জলবায়ু, ভূগোল, প্রানী-উদ্ভিদজগৎ নিয়ে যে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়, তা অভিনব। তারপরেও এটা ভুলে যাওয়া যায় না যে, এ রচনার প্রাণ হলো কাম প্রসঙ্গ। নদীর বর্ণনার উপমায়, প্রাণী নির্বাচনে (বর্ষাতে যাদের প্রজননকাল), শহরের নারীকুল পরিচয়ে - সর্বত্র আমরা দেখি এই বিষয়ের আধিক্য। অবশ্য আদি ভারতীয় সাহিত্যকর্মে রতিশাস্ত্রের উপস্থিতি কম ছিল এটা বলা যাবে না, কোনভাবেই। অথর্ব বেদ থেকে শুরু করে উপনিষদ হয়ে কামসূত্র, শৃঙ্গারশতক - সবখানেই এই যৌন প্রণয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা। কিন্তু একমাত্র মেঘদূতেই এটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও মনোহর হয়ে উঠে বিষয়বস্তুর সন্নিবেশনে ও কবির মুন্সীয়ানায়। 
আবার এ কাব্যের নায়ক যক্ষ প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় না। সে যুক্তিতে ভুল করে না যা আধুনিক সাহিত্যে হরহামেশাই দৃষ্ট হয় যে প্রেমিকের প্রেমে পাগলপারা হয়ে এমন কিছু বলছে বা করছে যা সুস্থ অবস্থায় সে করতো না। যক্ষ এখানে তাল হারায় না। সে জানে, এই বিরহ সাময়িক, তাই সে তার বিরহগ্রস্তা নায়িকাকে সান্ত্বনা দেয়। তাই তাঁর থেকে আমরা রোমিওর মত প্রলাপ পাই না। পাই গোছানো পত্রের ফিরিস্তি, আর পুঙ্খানুপুঙ্খ দিকনির্দেশ। আর সেটা করতে যক্ষের প্রস্তুতি সেনাপতির যুদ্ধে যাবার আগের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মতই। কিন্তু আক্ষেপ কেবল এই স্থানে যে - এই বিরহের প্রধান কারণ এক বছর অনৈচ্ছিক ইন্দ্রিয়দমন। মানবিক প্রেমের ভাব অনুপস্থিত না হলেও প্রধান নয়। আরেকটি বিষয় হল, তাঁর বিরহ যতটা না নিজের জন্য, তার থেকে বেশি তাঁর প্রিয়ার জন্য। তাই প্রিয়ার বিরহে বাক্যব্যয়ও বেশি। 
এই বর্ষা বিরহের ব্যাপারটা আবহমান কাল ধরেই এতো প্রচলিত তার মূল কারণ হয়তো মেঘদূতের এতো জনপ্রিয়তা। তাই তো চণ্ডীদাস থেকে বিদ্যাপতি হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই বর্ষার সাথে প্রেম ও বিরহের এক অসামান্য মেলবন্ধন রচনা করে ফেলেন। উদাহরণঃ

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর                        মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর ।।
-বিদ্যাপতি
সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা-
 অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা।
 চেয়ে থাকি যে শূন্যে অন্যমনে
  সেথায় বিরহিণীর অশ্রু হরণ করেছে ওই তারা।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যেখানে মেঘদূতের যক্ষকে ভোগবঞ্চিত কামাতুর নগরবাসী হিসেবে মনে হয় সেখানে আধুনিক কবির লিখা অতি সুশিলীত ও প্রাণবন্ত। জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'আকাশলীনা' তে প্রেমিকাহীনা অভাবের শুদ্ধ বেদনা ধ্বনিত করেছেন-

সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,
বোলোনা কো কথা ওই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;


আধুনিক কবিদের এক-একটি রচনা হল শূন্যতার হাহাকার, আর যক্ষের উক্তি একটি অভিরাম কারুকর্ম, যেখানে বিরহদশা প্রথানুযায়ী সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ১০৭ নম্বর শ্লোকে যক্ষের আক্ষেপ আমরা দেখি যে সে প্রিয়ার নানা উপমা নদী, চাঁদ, হরিণ, গাছের লতায় দেখতে পেলেও এক জায়গায় সবকিছু পাচ্ছে না।  আর আধুনিক কবির আক্ষেপ হলো প্রিয়া তাঁর এখন অন্য কাউকে ভালোবাসছে।
রোমান্টিকতার সংজ্ঞা যুগে যুগে কতখানি বদলেছে তারই প্রকাশ হচ্ছে এই অনুচ্ছেদে।
এরই সাথে একটি অদ্ভূত বিষয়ের ব্যাপারে বুদ্ধবাবু আমাদের অবহিত করেন। যেমনটা গ্রিক রোমান কাহিনীতে অনিষ্টসাধনকারী নারীর পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনঃ মেডুসা, প্যান্ডোরা, সাইরেন বা সেমিটিক ধর্মে লিলিথ, ডেলাইলা। ভারতীয় ধর্মকথায় এ ব্যাপারটি অনুপস্থিত। বরং নারী বেশ কল্যাণমুখী ও সম্ভ্রমের দাবীদার। একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে চণ্ডী বা কালি। একমাত্র তাঁকে দিয়েই ধ্বংসের উন্মাদনা কল্পনা করা হয়েছে ভারতীয় ধর্মগ্রন্থে। নয়তো নারীদের অনিষ্টসাধনের দৌড় স্বর্গের অপ্সরা রম্ভা, মেনকা হয়ে মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করা। নারীদের এই বিশেষ অবস্থার কারনেই সংস্কৃত কবিতায় নারীর উপস্থাপন বিশ্বের অনেক জায়গা হতে আলাদা।

৫) মেঘদূতের যক্ষের অবস্থা ও তাঁর বলা প্রতিটি বাণী নির্দ্বিধায় তাঁর কামুকত্বের প্রকাশ হিসেবে মেনে নিতে হয়। আর এতেই এ কাব্যের সার্থকতা। রতিক্রিয়ার এ বিশ্বরূপ পৃথিবীর আর কোন কাব্য আমাদের দেখাতে পারে নি। কোন নদীর ঢেউয়ে রূপসীর ভ্রূভঙ্গি , কোন নদীর ঘূর্ণি আবার প্রেয়সীর নাভির ভাব দেখাচ্ছে, কোন নদীর বায়ু আবার মিলনোৎসুক প্রিয়ার মতো চাটুকার, কারো বাতাসে যুবতীর জলকেলির সৌরভ ভেসে আসছে। এহেন রূপ বর্ণনার গুণেই কাব্যটির যৌনধর্ম পরিপূর্ণ। কবি কাউকে বাদ দেন নি - গ্রামবধূ, নগরবনিতা, মালিনী, বারাঙ্গনা, যক্ষনারী, নর্তকী, দেবকন্যা। এদের সাওবার মাঝে কবি খুঁজে নিয়েছেন কামের অনুষঙ্গ। তাদের অভিসার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইঙ্গিত, মিলনেচ্ছা, চলন, নর্তন - সবকিছুতে কবি মিশিয়েছেন যৌনতা। এমনকি যেসব প্রাণী বা পাখির কথা উল্লেখ করেছেন, সকলের প্রজনন ঋতুও বর্ষা। তাদের ব্যাপারেও কবি এ দিকে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আনতে ক্ষান্ত হন নি। যক্ষও এখানে পুরোপুরি নিশ্চিত প্রিয়া তাঁর অনন্যগামী হবে না, যক্ষ নিজে হলেও। তাই তাঁর উদ্ভ্রান্ততাকে ঠান্ডা করতে মেঘকে দিয়ে সে কাল্পনিক বার্তা পাঠাচ্ছে। আর আমরাও এই কাব্য পাঠ করতে করতে তাতে বুঁদ হয়ে তাই সত্য বলে ধরে নিচ্ছি। এখানেই কালিদাসের সার্থকতা।

৬) আশাতীতের নিরন্তর প্রত্যাশা - এই হলো রোমান্টিক আর্টের সারবস্তু। আশাতীত এখানে অবাস্তব নয়, বরং সেইসব গোপন সম্বন্ধ যা সাধারণ বুদ্ধিতে আসে না কিন্তু কবির কাছে তার সম্ভবপরতা তর্কের বাইরে। আর এসবের প্রকাশে উঠে আসে অনন্য কিছু উপমা, রূপক। এই অনুচ্ছেদ তাদেরকে নিয়ে।
মেঘদূতের যেসব উপমা মনোমুগ্ধকর তারা চিত্রধর্মী সাহিত্যের উত্তম উদাহরণ, ছবি হিসেবে এর অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু এতে অপ্রত্যাশিতের ধারণা জাগিয়ে তুলে না। 

মহান তার চূড়া ব্যাপ্ত করে নভে শুভ্র কুমুদের কান্তি,
নিত্য জমে উঠা অট্টহাসি যেন রাষ্ট্র করেছেন ত্র্যম্বক। (৫৯)

স্বল্পবিলসিত আভাসে নেভে, জ্বলে যেমন জোনাকির পুঞ্জ,
তেমনি বিজলির স্ফুরিত দৃষ্টিতে তাকাবে ভবনের মধ্যে। (৮৪)

বিরহশয্যায় শুয়েছে একপাশে, শীর্ণ তনু মনোকষ্টে,
পূর্বাকাশে যেন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের শেষ কলা উদিত- (৯২)

মেঘলা দিনে যেন মলিন কমলিনী, জেগেও নেই, নেই ঘুমিয়ে (৯৩)

এসব ক্ষেত্রে অর্থাৎ সংস্কৃত উপমাগুলোতে উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে দৃশ্যমান এক সাদৃশ্য আছে। তুষার ও মহাদেবের অট্টহাসি-দুইই শুভ্র। জোনাকি ও বিজলি - দুটিই ক্ষণকালের জন্য জ্বলে উঠে। বিরহ ও অমাবস্যার আগের রাতের মলিন চাঁদ ইত্যাদি। আবার ইউরোপে এই উপমার চমক অনেকখানিই ভিন্ন। দান্তের ইনফার্নোতে আমরা পাই-

Knitting up their brows they squinnied at us
Like an old tailor at the needle's eye.

এই যে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকতা কিন্তু এর অভিনবত্বের কারণে দান্তের কাছে পাঠকগণ কৃতজ্ঞ। ভাবনার সীমানা এর থেকে অনেক প্রসারিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার শেক্সপিয়ার প্রকৃতিগত মিল মাথায় রেখে উপমার গাঁথুনি দিয়ে যান। টেম্পেস্ট সাগর সম্বন্ধীয় বলে এই অংশে নাবিকের সাথে যোগ করানো যায় এমন বস্তুর উপমা ব্যবহৃত হয়েছে-

Full fathom five thy father lies:
Of his bones are coral made;
Those are pearls that were his eyes;

বুদ্ধবাবু প্রবন্ধের এই পর্যায়ে এসে কালিদাসকে তাঁর স্বকীয়তা রক্ষা না করার অপবাদ দিয়ে বসেন। কুমারসম্ভব   রঘুবংশে তিনি লতা প্রসঙ্গে 'পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকস্তনাভ্যঃ' ও 'তন্বীং স্তনাভিরাম স্তবকভিনম্রাম' ব্যবহার করেছেন। তার ব্যত্যয় হয়নি মেঘদূতেও। নারীদেহের বর্ণনায় কালিদাস পূর্বসূরীদের ছাপিয়ে যেতে পারেননি। যেখানে জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকের The Birth of Venus এ আমরা পাই যথাযথ নারীদেহের নিরুপম উপমাযোগে বর্ণনাঃ

Like moons the knees rose brightly
and ducked into the cloud rims of the thighs;
the calves’ slender shadows retreated,
the feet flexed and grew luminous,
and the joints came alive 
like the throats of drinkers.

And in the hips’ chalice lay the belly,
like a young fruit in a child’s hand.
Within its navel’s narrow cup was all
the darkness that this bright life contained.
Beneath it the small wave rose lightly
and lapped continuously toward the loins,
where now and then there was a silent ripple.
But translucent and yet without shadow,
like a birch stand in early April,
warm, empty, and exposed, lay the sex.
********
Then into this body’s dark dawning
came the first breath like morning wind.
In the vein-trees’ tenderest branches
a whispering arose, and the blood began
rushing louder over its deep places.
And this wind increased; now it plunged
with all its might into the newborn breasts
and filled them and crowded into them,-
so that like sails full of distance
they drove the light girl toward the shore.

And thus the goddess landed.

অথবা আমাদের সবার প্রিয় জীবনানন্দ যখন তাঁর বিখ্যাততম কবিতায় আমাদের নতুন এক রূপকল্পের স্বাদ শেখানঃ
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।



কোন ধরণের যৌনতা ছাড়াই নারীরূপের অমিয় চিত্রকল্প আমরা দেখি বনলতা সেনের মাঝে। সংস্কৃত কবিতায় এই আবেদনটাই অনুপস্থিত এর ব্যাকরণ, রীতি, অগ্রজদের অনুসরণীয় ধারার কারণে। 

নারীদেহ ছেড়ে এবার যদি অন্যান্য বিষয়ের রূপকের চিন্তা করি সেখানেও জীবনানন্দের আরেকটি উপমা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। উটের গ্রীবা নিস্তব্ধতার তুলনা হয় কিনা সেটা আকস্মিক আমরা না বুঝলেও সমগ্র কবিতার পটভূমির সাপেক্ষে আমরা এই উদ্ভট উপমার সারবস্তু বুঝে নিতে পারি। আট বছর আগের একদিন কবিতার বিষয়বস্তু এই তুলনার জন্য খুব বেশি অমূলক হতে পারে না। বরং, এটাই যেন উপযুক্তঃ
কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম— অবিরাম ভার

সহিবে না আর—’

এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।

এ থেকে বুঝা যায় যে, কবিতা আমাদের মনের জগতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেন। আমাদের কাছে তখন নিকট-দূর, অতীত-ভবিষ্যৎ, দৃশ্য-অদৃশ্য, কল্পনা-বাস্তবের সীমারেখা ঘুচে যায়। আমাদের মানসজগতে যুক্ত হয় নিত্যনতুন রাজ্য। চিন্তার নতুন কিছু জানালা, নতুন কিছু চশমা। রোমান্টিক আর্ট আমাদের শিখিয়েছে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব হতে মুক্ত হতে। শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবিরা তাই যে জগত সৃষ্টি করেছেন সেখানে সব সীমানা তুচ্ছ, সব অন্বয় উল্টে যায়, আমরা অজানাকে জয় করতে পারি। তাই বোদেলেয়ার ক্ষুদার্ত শিশুর চোখে রুটির মাঝে স্তনের উষ্ণতা খুঁজে পান, রিলকে অরফিয়াসে গীতধ্বনিতে বৃক্ষের পান যা কানে উঠে বসে। আর কালিদাস তাঁর সংস্কৃতে যা করেছেন তা হলো, তাঁর অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের প্রথার চরম উৎকর্ষতা বিধান করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এটা ভুলে যাওয়া চলবে না যে, কালিদাসের মাধ্যমে আমরা যা পাই, তা হল সংস্কৃত কাব্যের সর্বোৎকৃষ্ট ভার্শন। পরিশীলিত, পীনোন্নত, পরিষ্কার ও সর্বোপরি প্রকৃষ্ট।

৭) আমাদের বুদ্ধির সঙ্গে আমাদের আনন্দের সম্বন্ধটা খুব অদ্ভুত। যে জিনিস একবারে সহজে বুঝে ফেলি, তাতে আমরা আনন্দ পাই না, আবার যে জিনিস আমরা একটুও বুঝতে পারি না, তাতেও আমরা আনন্দ পাই না। বুঝা-না বুঝার মধ্যে খুব সরল একটি পর্দা তৈরি করতে পারলেই কবির সার্থকতা বলে কিটসের বিশ্বাস। ক্লাসিকে এই জিনিসটার অভাব বলেই ধারণা বুদ্ধবাবুর। যা বলার তা কবিরা সরাসরি বলে দিতেন। কোন ধোঁয়াশা নেই, নেই কবিতা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অতিরিক্ত কোন জিজ্ঞাসা। তাই রবীন্দ্রনাথ যখন চিৎকার করে উঠেনঃ
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো
বা 
প্রদীপ ভেসে গেল অকারণে

তখন আমরা কথাটা সহজেই বুঝে ফেলি কিন্তু মর্মোদ্ধারের কোন কিনারা পাই না। আবার এন্টোনি এন্ড ক্লিওপেট্রা তে আমরা দেখি, মরণোন্মুখ ক্লিওপেট্রা বলে উঠেঃ

Peace, Peace
Dost thou not see my baby at my breast
That sucks the nurse asleep?
Or
O rose, Thou art sick! (William Blake: The Sick Rose)
Or 
That dolphin-torn, that gong-tormented sea. (W. B. Yeats: Byzantium)

এসব ভাষা বুঝতে আমাদের বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না। ঝামেলাটা হয় এর অর্থ বুঝতে। আর এখানেই আধুনিক কবিতার আত্মা। আমরা ধরা-অধরার মাঝে বিচরণ করবো। মাঝে মাঝে বুঝে উঠবো, আর সেই প্রাপ্তির আনন্দে বুঁদ হবার আগেই অন্য অর্থ আরো যৌক্তিক মনে হবে। আবার সবগুলিকেই যথার্থ হিসেবে ধরা যাবে। এই লুকোচুরি, এই ছিনিমিনি খেলাটাই কবিতা। যার প্রাণ আছে, আছে নিঃশ্বাসের মত ছন্দ, আছে হৃৎস্পন্দনের মতো গতি।

Buddhadeb Bose at his 50s
[Source: The Hindu]

এতকিছুর বালাই আমাদের মেঘদূতে না থাকলেও এই কাব্য আমাদের একঘেয়েমি আনে না। আনায় না গতানুগতিকতার অচ্ছেদ্য জাল। বারবার পাঠেও তাই আসে না ক্লান্তি। কিন্তু এসবের কারণ কালিদাসের ভাবনা নয়। ভাবনাগত দিক দিয়ে এই কাব্য সাধারণ। এক পেশেই বলা চলে। কিন্তু এ কাব্যের মূল আকর্ষণ এর গতি। যে সুললিত আবহে এর ধারা ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে আগায় সে ভ্রমণটাই আনন্দের। মন্দাক্রান্তা ছন্দের ঢেউয়ে চড়ে আমরা কর্ণেন্দ্রিয়ের সাথে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রী-সমন্বিত চেতনাকে আমরা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হই। দরকার শুধু আগ্রহ, সংস্কৃতের প্রতি ভালবাসা আর শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ।


Comments