নবদূর্গা বা দূর্গার নয়টি রূপ

Parijat Dey's pen drawing 
Source: Absolute Arts


শারদীয় দূর্গোৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশেষত শাক্ত হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ১০ দিনব্যাপী চলে দূর্গাদেবীর আরাধনা। ২০১১ সালের পূজায় ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ শহরে থানাঘাট এলাকায় একটি মণ্ডপ করা হয়েছিল, যার নাম ছিল 'নবদূর্গা'। যদিও প্রথমে মনে করেছিলাম 'নতুন' রূপে দূর্গা প্রতিমা দেখব কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হল। সেখানে আসলে দূর্গা দেবীর ৯টি রূপের প্রতিমা ছিল। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই রূপগুলোর পশ্চাৎ কাহিনী জানতে ইচ্ছে করেছিল। আফসোস! খুব বেশি জানতে পারি নাই। যৎসামান্য লিখার চেষ্টা করলাম।


নবরাত্রি ব্রত পালন করার সময় এই নয়টি রূপের পূজা করা হয়। বেদে এই রূপগুলোর বর্ণনা দেন ব্রহ্মা নিজে।

দেবনাগরী লিপিতেঃ
प्रथमं शैलपुत्रीति द्वितीयं ब्रह्मचारिणी ।
तृतीयं चन्द्रघण्टेति कूष्माण्डेति चतुर्थकम् ॥

पञ्चमं स्कन्दमातेति षष्ठं कात्यायनी तथा ।
सप्तमं कालरात्रिश्च महागौरीति चाष्टमम् ॥

नवमं सिद्धिदात्री च नवदुर्गाः प्रकीर्तिताः ।
उक्तान्येतानि नामानि ब्रह्मणैव महात्मना ॥

নিকটতম বাংলা রূপান্তরঃ

"আমি মহানন্দে ও শ্রদ্ধাভরে নয় মাতার স্তুতি পাঠ করছিঃ প্রথমে শৈলপুত্রিনী (হিমালয় তনয়া), দ্বিতীয়ে ব্রহ্মচারিনী (চির কুমারী ও শুদ্ধতম), তৃতীয়ে চন্দ্রঘণ্টা (গলায় সোমধারী), চতুর্থে কুষ্মাণ্ডা (বিশ্বজগতের মাতা), পঞ্চমেতে স্কন্দমাতা (কার্তিক জননী), ষষ্ঠীতে কাত্যায়ানী (ঋষি কাত্যায়নের কন্যা), সপ্তমীতে কালরাত্রি (কাল ও অশুভ দূরকারী), অষ্টমে মহাগৌরী (তপস্বাবলে শিবকে স্বামী হিসেবে প্রাপ্তি) এবং নবমে সিদ্ধিদাত্রী (সিদ্ধি বা জ্ঞান প্রদায়ী)।"

শৈলপুত্রীঃ
शैलपुत्री : Śailaputrī

প্রথম রূপ হিসেবে আসে মাতা শৈলপুত্রী। তিনি 'পর্বত রাজু' এর (পর্বতের রাজা, হিমালয়) কন্যা ছিলেন। নবরাত্রির প্রথম রাতে উপাসনা করা হয়। জানা যায় এই রূপেরই অন্য নাম পার্বতী। এই পার্বতীর সাথেই বিয়ে হয় মহাদেব, শিবের। ইনি পূর্ব জন্মে রাজা দাক্ষার কন্যা ছিলেন। এই প্রতিমার ডান হাতে 'ত্রিশূল' ধারন করতে দেখা যায় এবং বাম হাতে পদ্ম শোভিত হয়। বাহন থাকে গরু। আর মুখাবয়ব থেকে শান্তিভাব উদ্ভাসিত থাকে এবং আশির্বাদ সুলভ হাসি ফুটে থাকে।

ব্রহ্মচারিনীঃ
ब्रह्मचारिणी : Brahmachāriṇī

এটি দ্বিতীয় রূপ। এই রূপে তিনি ব্রহ্মার জন্য তপস্যা করেছিলেন বলে (ব্রহ্মা-তপ) এই দূর্গাকে ব্রহ্মচারিনী বলা হয়। এই রূপ ভক্তি এবং ভালোবাসাকে প্রকট করে। দেবীর ডান হাতে থাকে জপ মালা এবং বাম হাতে থাকে কমন্ডলুক। এই রূপটিকে উমা এবং তপচারিনী নামেও ডাকা হয়। কুমারিত্ব রক্ষা ও কঠোর তপস্বাবলে বলীয়ান এই নারী রূপটি।

চন্দ্রঘন্টাঃ
चन्द्रघण्टा : Chandraghaṇṭā

অত্যন্ত রূপবতী এবং মোহময় এই রূপ দূর্গার তৃতীয় অভিমূর্তি। বাঘ বাহন হিসেবে থাকে। দশভূজা রুপে আবির্ভূত এই রূপে আট হাতে অস্ত্র থাকলেও বাকি দুই হাতের মুদ্রা হতে অনিষ্ট বিনাশ এবং আশির্বাদ প্রদান প্রতিভাত হয়। চন্দ্রঘন্টা নামটি ঐশ্বরিক শান্তি ও জ্ঞান চাঁদের আলোর মত মানব জাতির উপর বর্ষনের ইঙ্গিত বহন করে। অনেকের মতে, গলায় তিনি চাঁদ ধারণ করেন বলেই এহেন নামকরন।

কুষ্মান্ডাঃ
कूष्माण्डा : Kūṣmāṇḍa

চতুর্থ এই রূপ মূলত দুর্গার সূর্য হিসেবে আসীনতাই প্রকাশ করে। দশভূজা এই রূপে ছয় হাতে অস্ত্র থাকলেও বাকি চার হাতে গোলাপ এবং পদ্ম থাকে। তিনিই সমগ্র সৌরজগত নিয়ন্ত্রন করেন। হাজার সূর্য থেকেও উজ্জ্বলতর প্রতিমার মুখ। দেবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দশ দিকে ঘুরানো থাকে সূর্যের মত। তিনি কুমুদ দ্বারা পূজিত হতে ভালোবাসেন বলে 'কুষ্মান্ডা' নামটি প্রচলিত। বাহন বাঘ ।

স্কন্দ মাতাঃ
स्कन्दमाता : Skanda-Mātā

পঞ্চম এই রূপকে আগুনের দেবী হিসেবে মানা হয়। তিনি একটি পুত্র ('স্কন্দ' নামে। ধারনা করা হয় ইনিই কার্তিক) কোলে বহন করেন বলে তাকে স্কন্দ মাতা নামে ডাকা হয়। দেবীকে তিন চোখ এবং চার হাত বিশিষ্ট রূপে পূজা করা হয়। দু হাতে পদ্ম এবং অন্য দু হাতে নিবারন এবং আশির্বাদের মুদ্রা দৃষ্ট হয়। বলা হয় তিনি অতি মুর্খকেও অগাধ জ্ঞান দিতে পারেন। কালিদাসের রঘুবংশ ও মেঘদূত মহাকাব্য স্কন্দ মাতার আশির্বাদেই লেখার রূপ পেয়েছে বলে কথিত আছে। বাহন সিংহ।

কাত্যায়নীঃ
कात्यायनी : Kātyāyanī

ঋষি কাত্যায়ন জগজ্জননী কন্যা লাভের জন্য ধ্যান করেছিলেন বলে যমুনা নদীর পাড়ে তাঁর কন্যা হসেবে জন্মগ্রহণ করেন মহামায়া বা পার্বতী এবং পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ কে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ব্রজ মণ্ডলের প্রধান দেবীরূপে বিবেচিত। প্রতিমার চার হাত ও তিনটি চোখবিশিষ্ট রূপের এক হাতে অস্ত্র থাকে এবং অন্য হাতে ধরে পদ্ম। বাহন সিংহ।

কালরাত্রিঃ
कालरात्रि : Kālarātrī

সপ্তম এই রূপটিকে রাতের মতো কালো রূপে উপস্থাপিত করা হয় বলে নাম 'কালরাত্রি'। চুল থাকে খোলা ও রূপ উদ্ভ্রান্ত। চার হাত এবং তিন চোখ সম্বলিত ভয়াবহ এই অবতারের প্রতিমায় ডান হাতে এক ধারালো তরবারি এবং নিচের ডান হাতে আশির্বাদের মুদ্রা দৃষ্ট হয়। বাম হাতে থাকে অসূর মূণ্ড এবং অন্য হাতে প্রতিরোধক মুদ্রার ভঙ্গিমায় থাকে। বাহন একটি বিশ্বস্ত গাধা। এই অবতার অজ্ঞতা এবং অন্ধকার দূরীকরণের ইঙ্গিত বহন করে। কথিত আছে, অভিযানের রাতে বেরুলে কালরাত্রির রূপ দেখে এবং নাসিকা হতে আগুন নিঃসৃত হয় বলে বহু নর-নারী মুর্চ্ছা যায় । দেবীর একান্ত অনুসারীদের তিনি সমৃদ্ধি দান করেন বলে এই রূপটির অন্য নাম 'শুভঙ্করী'।

মহাগৌরীঃ
महागौरी : Mahāgaurī

এই রূপ চাঁদ এবং বেলী ফুলের মত সফেদরূপে উপস্থাপিত হয়। তিন চোখ এবং চার হাত বিশিষ্ট এই প্রতিমায় প্রায়ই সাদা এবং সবুজ শাড়ি পরানো হয়। দেবীর সমগ্র সত্ত্বা হতে শান্তি এবং সৌম্য ভাব বিচ্ছুরিত হয়। গরুর উপর আসীন প্রতিমায় নিচের বাম হাতে একটি ত্রিশূল শোভা পায় এবং উপরের বাম হাতে শত্রুবিনাশিনী মুদ্রা দৃষ্ট হয়। অপরদিকে ডান দু হাতে আশীর্বাদ মুদ্রা এবং তাম্বুরা দেখা যায়।

সিদ্ধিদাত্রীঃ
सिद्धिदात्री : Siddhidātrī

বিজয়া দশমীর আগের রাতে অর্থাৎ নবরাত্রির শেষ রাতে এই রূপের উপাসনা করা হয়। মহা শক্তি আটটি সিদ্ধি দান করেন যা অষ্টসিদ্ধি নামে সমধিক পরিচিত -
  • অনীমা (নিজ দেহকে অণুর ন্যায় ছোটতে রূপান্তরিত করা)
  • মহিমা (নিজ দেহকে বিরাটকায় আকার দান করা) 
  • গরিমা (নিজ দেহকে অসীম ভারী করে তোলা)
  • লঘিমা (নিজ দেহকে ভরহীন করে ফেলা)
  • প্রাপ্তি (যেকোন স্থানে যেকোন সময় অবস্থান করা)
  • প্রকম্য (নিজের বাসনা অনুধাবন করা)
  • ঈশিতভা/লিশিতভা (প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ)
  • ভাশিতভা (প্রাকৃতিক শক্তির উপর আসীন হওয়া)
দেবী পুরান মতে, মহাদেব এই সকল সিদ্ধি মহা শক্তিকে সাধনা করে পেয়েছিলেন ফলে দেবীর বরে মহাদেবের আধেক শরীর দেবী হতে পুষ্ট হয়, যার কারনে শিবের আরেক নাম 'অর্ধনারিশ্বর'। অনেকের মতে তাঁর বাহন সিংহ, আবার অনেকে দাবী করেন তিনি পদ্মে আসীন থাকেন। সব দেবতা, ঋষি, মুনি, সিদ্ধি যোগীই সিদ্ধিদাত্রি দেবীর উপাসনা করে থাকেন।

যে সাধক এ নয় রূপের নাম সর্বদা স্মরণে রাখবে-সে আগুনে জ্বললেও সে তাপে ভুগবে না, সে নাশকতায় ভীত হলেও যুদ্ধে গেলে ধুঁকবে না। সে যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভ করবে।

দেবী দূর্গার আবির্ভাবঃ

মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে, মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর ইতোমধ্যে বরযোগে পুরুষের অবধ্য ছিলেন বলে বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, ‘প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এরপর সমবেত দেবতারা তেজ ত্যাগ করতে আরম্ভ করেন। যে যে দেবতার তেজ থেকে এই নারী মূর্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হলো, তা এ রূপ-‘মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুগণের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতার তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো।' এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র, পোশাক ও অস্ত্র দান করলেন। এক্ষেত্রে দেবতারা যা দান করলেন, তা হলো—'মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখক্ষ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন।' এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতিরূপ।


লেখাটি কোন ধর্মমত প্রচার বা সমালোচনার উদ্দেশ্যে লিখিত নয়। সাধারণ জিজ্ঞাসা এবং কৌতূহল নিবারণের জন্য এটি একটি সামান্য প্রয়াসমাত্র।

Comments