বাংলা নববর্ষ ও কিছু কথা
বিষুব সংক্রান্তি। ইসলামিক চন্দ্র দিনপঞ্জির সাথে ভারতীয় সৌর দিনপঞ্জি মিলিয়ে আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিদ ফতেউল্লাহ সিরাজি একটি নতুন ফসলি দিনপঞ্জি চালু করেন, সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর আশির দশকে। যা পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা আর পাঞ্জাব এলাকায় এই উৎসব পালনে ভাবগাম্ভীর্য অতুলনীয় এবং আয়োজন সর্বাধিক হত। বলা বাহুল্য, দুই অঞ্চল মিলিয়ে সমগ্র উপমহাদেশের প্রায় ৬০% উৎপাদন সংঘটিত হত। আকবরের দুই ফলদায়ী সুবাঃ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের বঙ্গ ও সিন্ধুর পাঞ্জাব। ১৫৫৬ সালে আকবরের সিংহাসন আরোহণকে মূলত এর গণনার ভিত্তি ধরা হয়। অনেকের মতে, খাজনা আদায়ের সুনির্দিষ্টতা আনয়নে এই ব্যবস্থা নেন আকবর। আবার অনেকের মতে 'পুণ্যাহ' নামে যে কর আদায় এবং রাজকীয় জনসংযোগের রীতি বাংলায় প্রচলিত হয়েছিল তা বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খানের কীর্তি। আবার পূর্ববাংলার অনেকের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ তে রাজা বিক্রমাদিত্য এই দিনপঞ্জির সূচনা করেন যা আজো বিক্রমি ক্যালেন্ডার হিসেবে বিভিন্ন স্থানে অনুসৃত হয়। যদিও ইতিহাসের সেই সময়টাতে বিক্রমাদিত্য নামে কোন সম্রাট বা বিশাল এলাকার রাজা বর্তমান ছিলেন না। সেই ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র কোন সামন্ত বিক্রমাদিত্যের কীর্তি হতে পারে। বিক্রমাদিত্য নামে যাকে সম্মানিত করা হয় তিনি মূলত ২য় চন্দ্রগুপ্ত (৩৭৮-৪১৫)। গুপ্তদের ৩য়/৪র্থ সম্রাট। তাঁর সময়েই সমগ্র ভারতবর্ষ জ্ঞান, দর্শন, শক্তিমত্তার শিখরে আরোহণ করে।
ইংরেজি যে গ্রেগরি বর্ষব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে রক্ষিত হয় তার প্রথম দিনের তাৎপর্যের চেয়ে এশিয়ার জনপ্রিয় এই দিনটির গুরুত্ব পৃথিবীর আবর্তনের সাথে গুরুতরভাবে জড়িত বিধায় অনেক বেশি। মার্চে পৃথিবীর উপর সূর্যের আলো লম্বভাবে পড়ার ক্ষেত্রে বিষুব রেখা পার করে ফেলে। এর কদিন পর কর্কটক্রান্তি রেখার আশে পাশের মানুষগুলো গ্রীষ্মের আঁচ পেতে শুরু করে। বসন্তের বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। আকস্মিক এই সূর্য কিরণের পরিবর্তনে আবহাওয়াও অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। হঠাৎ নিম্নচাপ ও ক্ষণস্থায়ী বর্ষন এ সময়ের বৈশিষ্ট্য। দক্ষিণ এশিয়ার সুবিখ্যাত মৌসুমী বায়ুর প্রবাহ এ সময় থেকেই শুরু হয়। ভার্নাল ইকুইনক্স এর সমসাময়িক এই উৎসব মানুষের অত্যন্ত পুরনো কটি উদযাপনের মধ্যে একটি - তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বছরের প্রথম দিনের উৎসব হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা এলাকায় বিভিন্ন নামে এর উদযাপন হয়।
- আসামে বিহু [বোহাগ/রঙ্গালী বিহু, (সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ননের প্রধান কয়েকটি অবস্থান ও ঋতুবৈচিত্র্যের প্রারম্ভ নির্দেশ রাখার
জন্য - সকল সৌর
ক্যলেন্ডারের একই
নীতি) আসামে তিনটি
দিন নির্দিষ্ট করে
বিহু উৎসব পালিত
হয়; ১৩ এপ্রিল,
- মিথিলাতে (উত্তর বিহার আর নেপালের অংশবিশেষের ঐতিহাসিক নাম) জুড়ি শীতল উৎসব,
- থাইল্যান্ডে সংক্রাম (সংস্কৃত 'সংক্রান্তি' থেকে উদ্ভূত। ১৮৮৮ সালের এই দিনটিকে ১ এপ্রিল নিয়ে আসা হয়, ১৯৪০ এ এসে পুরোপুরি গ্রেগরি ক্যালেন্ডারে স্থানান্তরিত হয় থাইল্যান্ড)
- নেপালে নয়াবর্ষ (সেখানে বিক্রমাদিত্য দিনপঞ্জি অনুসৃত হয়),
- তামিলনাড়ুতে পুট্টান্ডু বা পুঠান্ডু (তামিল চিথিরাই মাসের প্রথম দিন)
- কেরালাতে বিষু সংক্রম (ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় অনুসৃত সৌর দিনপঞ্জির মেদাম মাসের প্রথম দিন)
- নেপালের বোড়ো জাতির বিসাগু,
- পাঞ্জাবে শিখদের বৈশাখী (নানকশাহি দিনপঞ্জি মতে নববর্ষের প্রথম দিন। সম্রাট আলমগীরের নির্দেশে ৯ম শিখ গুরু তেজ বাহাদুরকে হত্যা করার ফলে এই দিনে ১০ম গুরু গোবিন্দের অভিষেক হয় এবং প্রখ্যাত খালসা গঠিত হয়)
- উড়িষ্যায় পান সংক্রান্তি বা বিষুব সংক্রান্তি (তাদের মেষ মাসের প্রথম দিন)
- শ্রীলঙ্কায় আলুথ অবরুদ্ধ (অনেক ঐতিহাসিকের মতে সিংহল দ্বীপটিতে প্রথমবারের মত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সুনির্দিষ্ট সরকারি কাঠামো ও হিসাবরক্ষণের ব্যবস্থা করে 'বিজয়' নামের এক নির্বাসিত বাঙালি রাজপুত্র। সে সূত্রমতে, ভারত মহাসাগরের দ্বীপটির এ উৎসব পালন অত্যন্ত স্বাভাবিক)
- কম্বোডিয়াতে চউল চনাম থমে (দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি বহুভাবে ভারতীয় দ্বারা প্রভাবিত আদিকাল থেকেই। আঙ্কর ওয়াট মন্দিরটি দেশটির পতাকায় শোভিত, কোট অফ আর্মসে তামিল চোলা সাম্রাজ্যের মত হাতির ব্যবহার, এবং একই কায়দায় কৃষিকাজ তথা বর্ষ উদযাপন)
- সংকান বা পি মাই লাও (লাওসে নববর্ষ পালনের উৎসব। লাওসও একটি অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ও কম্বোডিয়ার প্রতিবেশী)
- মায়ানমারে থিঙ্গিয়ান (মূলত বৌদ্ধ ঐতিহ্য মেনে বার্মায় বসন্ত থেকে গ্রীষ্মে বা মীন রাশি হতে মেষ রাশিতে পদার্পন উপলক্ষ্যে এই উৎসব পালিত হয়। এবং বলাই বাহুল্য, মায়ানমার একটি ধান উৎপাদনকারী রাষ্ট্র)
- বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝেও একই ধারায় একই রকম উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়। (বিঝু, বৈসুক, সাংগ্রাই)
মজার বিষয় হচ্ছে, যদি সমকাল বিবেচনায় রাখি অর্থাৎ ভার্নাল বা মার্চ ইকুইনক্স এর আশে পাশের ২০দিন হিসেবে রেখে সারা বিশ্বের সকল অঞ্চলে ছুটির দিন বা বর্ষবরণের ধরন পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখাযাবে, সুদূর মেক্সিকোর আজটেকদের থেকে শুরু করে জাপানের শিন্টোদের শুনকি করেইসাই দিনের মত উত্তর গোলার্ধে বসবাসরত সকল মানবগোষ্ঠীই বহুকাল আগে হতে এই সময়কালের যে কোন দিন বা পর্যায়ক্রমিক কিছু দিনকে ছুটির দিন বা উৎসব হিসেবে পালন করেছে বা করছে।
প্রতিটি অঞ্চলে
(এখানে দেশ ব্যবহার সমীচীন নয়) বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন বিশ্বাসে এই সময়কালটি নানা
ভাবে উদযাপিত হলেও
সবখানেই নানারকম মুখরোচক খাদ্য
প্রস্তুত অভিন্ন। কোথাও মঙ্গল শোভাযাত্রা, কোথাও পানি নিক্ষেপ, কোথাও বা ফুল
ছুড়াছুড়ি, কোথাও
বিশাল ভোজায়োজন, কোথাও
নানা দেব-দেবীর
পূজা দিয়ে এই
দিনের আশে পাশের
কয়টি দিন পালিত
হয় সমগ্র এশিয়াতে। উদযাপনের রীতি
এবং উপাদান বছরের
পর বছর নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
আসন্ন দিনগুলোতেও হবে।
দিনটির তাৎপর্য যতটা
না কোন নির্দিষ্ট প্রকৃতিবাদী ধর্মঘেঁষা তার চেয়ে বেশি
বোধ হয় উত্তরাধুনিক যুগের মানববাদী ধারণায়
সূর্যের তৃতীয়
গ্রহে বসবাসকারী সাধারণ
মানুষ হিসেবে একটি
চক্রের পূনর্জন্মের মুহুর্ত বা আবেশকে বরণ
করে নেয়া এবং
সর্বোপরি কৃষিকাজের সাথে সম্পর্কিত বিধায়
শাসকশ্রেণীর করাদায়ের সুবিধার লক্ষ্যে উৎসব হিসেবে রূপায়িত।
উৎসঃ দি ডেইলি স্টার |
Comments
Post a Comment