পশ্চিমের চম্পককুমারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ


'চাঁপাইয়ের সোনা মসজিদ যদি ছোট হয় তাহলে বড় সোনা মসজিদ কোথায়?' 

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গুগলের কবাটস্থ না হয়ে সিদ্ধান্ত ছোটকেই দেখে আসা। বয়স তো প্রায় ৫০০ পার করে ফেলেছে!
সকাল সকাল পৌঁছানো গেল চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জ উপজেলার উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তে। বাংলাদেশেরও সর্বপশ্চিম প্রান্ত। আশ্চর্যজনকভাবে এখানকার মানুষের মুখে মালদার টান স্পষ্ট (প্রকৃতপক্ষে, এটা আশ্চর্যজনক নয়। ইতিহাস তা বলবে না। মোঘল আমল থেকেই এটি মালদহ জেলার অন্তর্গত ছিল।)। যাকে বলে প্রায় গৌড়ীয় বাংলা। বাক্যের শেষে একটি মনোটনাস টান। শুনতে খারাপ লাগে তো নাইই বরং আমের মত মিষ্টি লাগে। আমের রাজধানী বলে কথা। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করা যায় - একমাত্র এই এলাকার মানুষগুলোই দন্ত্য-স এর প্রকৃত উচ্চারণ করে থাকে যা সামনের দাঁতের সাহায্যে উচ্চারন করতে হয়। কানসাটকে তারা 'কান্‌-শাট' বলছে না। পূর্ববাংলার আমরা ধুমিয়ে যখন 'ইতিহাস', 'বালিশ' থেকে 'শুরু' করে 'আষাঢ়-শাওন' গুলিয়ে 'মানুষ'এ 'শেষ' করি, তখন আমাদের কিন্তু অতো বাছবিচার থাকে না। সবাই 'তালব্য-শ' আমাদের কাছে। আবার, শুদ্ধ 'স' এর জন্য একটা ক্ষতিপূরণও চাঁপাইয়ানদের দিতে হয়েছে, আর তা হল 'শিবগঞ্জ' তাদের মুখে 'সিবগঞ্জ' হয়ে গেছে!
মহানন্দার ধারাপুষ্ট এ জনপদের অন্তর্ভুক্তি বরেন্দ্রের সাথে। যদিও এ উক্তিতে আমার নিজেরই দ্বিমত আছে,কেননা মহানন্দা গঙ্গার উপনদী। ফলে নদীগর্ভ বহু আগের উত্তাল দশার ইঙ্গিত দিলেও বর্তমানে এর মর-মর দশা। শিলিগুড়ি বাংলাবান্দা পাড়ি দিয়ে আসা প্রমত্তা মহানন্দা চাঁপাইয়ে তার ধার সিংহভাগ খুইয়ে ফেলেছে। জনপদটির সুলতানি আমলের রাজধানীর খুব কাছেই অবস্থান থাকায় গৌড় হিসেবেই পরিচিত ছিল। আবার, মোঘলদের সময় বাদশাহ আলমগীরের আমলে ধর্ম প্রচারের জন্য সুফীদের আগমন ঘটলে অত্র এলাকার শান বজায় থাকে। এমনকি স্বাধীন নবাবদের সময় নবাবেরা গঙ্গার দক্ষিণ পাড়, মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায়ই মৃগয়ায় বেরুতেন এখানকার জঙ্গলে। সেসব অভিযানের অলংকৃত রূপ সমগ্র উত্তরবঙ্গেই নানা স্থাপনায় দেখা যায় পোড়ামাটির ফলকে। নবাবদের বিহারের ক্ষেত্র ছিল দেখে নাম হয় নবাবগঞ্জ। আর বেহুলার শ্বশুরবাড়ি লখিন্দরের রাজধানী চম্পক নগর এই এলাকাতেই ছিল বলে এর বিকৃতরূপে নাম 'চাঁপাই'। ব্রিটিশরা এই জেলা নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। দেশভাগের আগ পর্যন্ত বেঙ্গল প্রদেশের মালদা জেলার অধীন থাকলেও র‍্যাডক্লিফ মহাশয়ের(!) তা পছন্দ হয় নাই। মালদা থেকে দশ কিঃমিঃ দূরে টেনে দিলেন বিভেদরেখা।
যে কারনে ঝোলের তরকারিটাও মিষ্টি মিষ্টি লাগে আর প্রতিষ্ঠিত মিষ্টি বা দুধ চা নিলে তো কথাই নাই। পুরো গলনালী থেকে শুরু করে মগজটা পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়। পশ্চিমা দাদাদের এত কাছে বলেই বোধহয় স্বাদবৃন্তগুলো এখনো আগের নেশাতেই মজে। নিম্নবিত্তদের ঘরের ছাউনি পোড়ামাটির টাইল দিয়ে ছাওয়া। ব্যাপারটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক ছিল আমার কাছে।
যাই হোক, ইতি নামের হাঁসের গলা চেপে এবার মসজিদের হাঁসের দিকে যাই।
দেশের সর্বপশ্চিম প্রান্ত। স্থল বন্দরটার নামই ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর। এর ঠিক পাশেই সুলতানি আমলের এক দীঘি। নাম খানিয়া। এরই পাড়ে বর্গাকৃতির সুলতানি আমলের মসজিদ। স্থানীয়ভাবে চামচিকা মসজিদ নামে পরিচিত। আবিষ্কারের সময় প্রচুর চামচিকার বাসা ছিল দেখে বোধ করি এহেন নামকরন। প্রকৃত নির্মাতার সন্ধান না মিললেও স্থাপত্যরীতি স্পষ্টভাবেই সুলতানি আমলের কথা জানান দেয়। রাজবিবি মসজিদ নামেও পরিচিতি থাকাতে অনেকের মতে সুলতানী আমলের কোন এক সুলতানের হারেমের প্রভাবশালী একজন নারীর নামে এ মসজিদের নামকরণ। দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটির তৈরি খিলান সদৃশ অলংকরণ এতদ অঞ্চলের নিজস্বতা। বাংলার সুলতানদের সময়েই প্রথম মসজিদের দেয়ালে জানালার মত অনুভূতি দেয়ার জন্য এহেন কাজ করা হয়। রাজধানীর এত কাছে হওয়াতে এর নির্মানে যত্ন ও পরিশ্রমটা চোখে পড়ার মত। আবার মসজিদ স্থাপনায় মিনারের গায়ে বাঁশের মত সমদূরবর্তী রিং তৈরি করার মোঘল রীতি এখানে অপরিপক্ক অবস্থায় দৃষ্ট হয়। অনেকের মতে, এহেন স্থাপত্যরীতি তুর্কিতে আনাতোলিয়া রাজ্যে দেখা যায়। ফলে সমসাময়িক মোঙ্গল অভিযান থেকে বাঁচতে অনেক তুর্ক স্থাপত্য শিল্পী ভারতবর্ষে আসে এবং তার ছাপ সুলতানি বাংলা থেকে শুরু করে মোঘল উত্তর ভারত ও নবাবি-নিজামি দক্ষিণ ভারতে সবখানেই পাওয়া যায়। এই চামচিকার মসজিদের গম্বুজ আকৃতিটাও ১৬শ শতাব্দীর লক্ষনদুষ্ট। মূল প্রার্থনা প্রকোষ্ঠ একটি কেন্দ্রীয় বিশাল গম্বুজের নিচে ব্যপ্ত আর প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ছোট বারান্দার মত প্রশস্ত অংশে তিনটি ছোট ছোট গম্বুজ দ্বারা আবৃত। দেয়ালের পুরুত্ব মারাত্মক! ভিতরের অন্ধকারটা জমাট আর অনেক বেশি শীতল। ছাদের কার্নিশটি বক্রাকার, ভূমির সমান্তরাল না মোটেও। প্রাঙ্গনটাকে বেশ পরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংস্কারের পর পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু করছে বলে তৎপরতা দেখলাম না। স্থানীয়দের আগ্রহ চোখে লাগার মত। দল-বল বেঁধে আবালবৃদ্ধবনিতাকে হৈচৈ করতে করতে এক 'নদী'র খোঁজ করতে দেখলাম। কিন্তু তাদেরকে খানিয়া দীঘির নির্দেশনা দেয়াতে আশ্বস্ত হলো! 'নদীর পাড়ের মসজিদ' ই নাকি চামচিকা মসজিদ! দুই পক্ষের অন্তত এক জনের জলাধারের সংজ্ঞায়নে ভুল বিদ্যমান তা নিশ্চিত।


জানালার মোটিফ

খানিয়াদীঘি/ খঞ্জন দীঘি

রাজবিবি/চামচিকা/খানিয়াদীঘির মসজিদ


দীঘির পাড়ে ছোট খাটো একটি পিকনিক স্পটও চোখে পড়ে আমবাগানের মাঝে। শিবগঞ্জের রাস্তার ধারে যদি কোন পতিত জমি দেখা যায় তবে তা অবশ্যই কোন না কোন আম গাছের নিচের জমি! অঞ্চলের নিদেনপক্ষে ৯০ ভাগ লোক কোন না কোন ভাবে আম চাষের সাথে সম্পৃক্ত এটা তাদের মুখ থেকেই শোনা। আমগাছের দৈর্ঘ্য সন্দেহজনকভাবে কম, কেননা নিচের মাটি ক্রমাগত খুঁড়ে খুঁড়ে গোড়ার দিকে উঁচু করা হয় যাতে গোড়ায় পানি না জমে। ফলে বয়স্ক গাছগুলোকেও নিতান্তই চারাশিশু বলে মনে হয়। কিন্তু এসব গাছেই মণের পর মণ ধরে সুস্বাদু-রসালো আম। এসব দেখতে দেখতেই যাওয়া পড়লো শূন্য বিন্দু বা জিরো পয়েন্টে। পথে রঙ বেরঙের বহু হিন্দুস্তানি লরি চোখে পড়ে। বেশিরভাগেরই বাহিত পণ্য পাথর, আপেল এবং আঙ্গুর! লেন্সের সামনে যদিও ড্রাইভাররা বেশ বেশামাল হয়ে যায় - যার কারন আমার জানা নেই। উত্তর প্রদেশের একজন তো লেন্স তাক করাতে এমন ত্বরিত হল যে রাস্তার ধুলায় ফুসফুসের ত্রয়োদশ পরতের এল্ভিওলাই পর্যন্ত বাদামি হয়ে গেল! যাই হোক আশা ছিল, সীমানায় কোন কিঃমিঃ পোস্টের দেখা পাব, কিন্তু বিধি ভাম। ও পাড়ে স্রেফ মাহাদিপুর স্থলবন্দর। নিয়মিত ট্রাক, পাসপোর্ট-ভিসাধারী মানুষ আর কাক-কসাইয়ের দল হরহামেশাই পাড় হয়ে যাচ্ছে। বন্দরের ধারে পেলাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। রাজভোগ নাম মিষ্টির। এর নাম যদি কোন রাজার ভোজনবিলাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে তবে তার জিহবা নিঃসন্দেহে গবেষণার দাবি রাখে। অন্তঃপ্রকোষ্ঠ সহ সকল প্রত্যঙ্গ তীব্র অনাঝালীয় সৌকর্যে বিস্ফোরিত হয়। ভোজন রসিকতা শেষে এবার গন্তব্য তাহখানা।
শিবগঞ্জের তাহখানাটার মাহাত্ম্য এটাই যে এটা সমগ্র বাংলাদেশের প্রথম এমন দরবারি ঢঙ্গের স্থাপনা। মূলত দিল্লী লাহোরে এমন মসজিদ-মাজার-বাগিচার সমন্বয়ে বিশাল কমপ্লেক্স প্রথম গড়ে উঠে। বাংলাদেশে পরবর্তিতে এর থেকে প্রচুর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। দিল্লী হতে আগত শাহ্‌ নিয়ামতউল্লাহ (রঃ) ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বঙ্গ দেশে আসলে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় তনয় বঙ্গ সুবাদার শাহ্‌ সুজা তাঁর সম্মানে এই শিবগঞ্জে ১৬৫৫ সালের দিকে কমপ্লেক্স স্থাপন করেন। যা তিনি নিজে তাঁর সুবা দর্শনে আসলে ব্যবহার করতেন ও নিয়ামতউল্লাহ নিয়মিতভাবে এখানেই আস্তানা গেঁড়ে মৃত্যু অবধি থাকা শুরু করেন - যা এখানকার তথ্য বোর্ডে লেখা আছে। তবে এখানে তাঁর কাব্যচর্চা (কাশিদা) ও ইরহাম (ভবিষ্যৎবাণী) নিয়ে যে দাবি করা হয়েছে তা কিঞ্চিৎ অমূলক কেননা যে নিয়ামাতউল্লাহ ওয়ালীর কাশিদা ও ইরহাম জগতজোড়া আগ্রহ ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তিনি আরো বছর দুইশত পূর্বেকার পারস্যে ছিলেন বলেই আমার ধারণা। বরং শাহ্‌ নিয়ামতউল্লাহ দিল্লীর চিশতিয়া ঘরানার একজন সুফি ছিলেন যিনি রাজমহলে (বর্তমান ঝাড়খন্ডে) শাহ্‌ সুজার দরবারে ধর্মগুরু হিসেবে বাংলায় এসেছিলেন। পড়ে তিনি এ এলাকায় বসতি স্থাপন করলে সুজা তাঁকে দ্বিতল এক প্রাসাদ সদৃশ ইমারত বানিয়ে দেয়। এটার দ্বিতীয় তলা দীঘির সমতলে হলেও নিচতলা মাটির নিচে। গোসলখানা ও শৌচাগারে পানির পরিচলন ব্যবস্থা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। 



দাফিউল বালা দীঘি

শাহ্‌ নিয়ামতউল্লাহ (রাঃ) এর বারদুয়ারী মাজার

শাহ্‌ নিয়ামতউল্লাহ (রাঃ) এর তিন গম্বুজ মসজিদ

প্রাঙ্গনের কিছু বিরল জাতের গাছের দেখা পেয়ে তাই মুহূর্তের জন্য পারস্যের কোন বাগিচায় আছি বলে মনে হয়। শুধু ঝর্না ধারাটারই অভাব। যদিও পাশেই আছে দাফিউল বালা দীঘি। দীঘিতে আশ্চর্যজনকভাবে 'মান্নাতের মুরগি' নিক্ষেপ করা ও মহিলাদের গোসল করা নিষেধ। মাজার প্রাঙ্গণেই আছে গ্রানাইট পাথরের কারুকার্যময় বেশ কিছু কবর স্তবক আর স্তম্ভ। বারদুয়ারী স্থাপনা এই মাজারটি। চারদিকের দেয়ালে তিনটি করে দরজা। মাজারের সামনেই আছে তিনগম্বুজের সুন্দর একটি মসজিদ। সুবাদারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট সুফি সাধকের মাজার খুব সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর আগেই তৈরি করা! বাগান সহ মাজারের কমপ্লেক্সটি শীতলবিশেষ। তাহখানার আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে ঠাণ্ডা প্রাসাদ। ভক্ত-আশেকানদের পদচারনায় মুখর এ মাজার প্রাঙ্গন। স্থানীয়দের কাছে এই তাহখানার অর্ধ বাৎসরিক উরস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে আধা কিলো দূরে ছোট সোনা মসজিদ।
ছোট সোনা মসজিদ তার নামীয় বড়জন থেকে মাত্র ১৬ কিঃমিঃ তফাতে নির্মিত। মালদার বড় সোনা মসজিদ বারদুয়ারী মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। প্রাচীন সুলতানী বাংলার রাজধানী লক্ষ্ণৌতির দুটি স্বর্ণ টুকরা এ মানিক জোড়। দুটোর গড়ন অলংকরণ অনেকাংশে একই। ১৫০০ সালের দিকে নির্মিত বলে ধারণা করা হয় মসজিদটিকে। যা বড়টার প্রায় ২৫ বছরের আগের সময়। দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্ভের সময় আলেক্সান্ডার কানিংহাম এই মসজিদের ১৫টা গম্বুজে-কার্নিশে ও বড় সোনা মসজিদে স্বর্ণ মণ্ডিত কারুকাজ দেখতে পান। ফলে দুটোর নামই সোনা মসজিদ। 


ছোট সোনা মসজিদ

ছোট সোনা মসজিদের ব্ল্যাক গ্রানাইটের অলংকৃত পিলার

ছোট সোনা মসজিদের দেয়াল সজ্জা

ছোট সোনা মসজিদের অভ্যন্তরের পশ্চিম অর্থাৎ মিহরাবের দেয়াল

মাঝের সারিতে তিনটি চৌচালা গম্বুজ ও দুইদিকে বারটি সৌম্য গম্বুজ নিয়ে দন্ডায়মান মসজিদটি মালদার বড়টি থেকে বেশ ভালো অবস্থায় আছে এখন। সুলতানী আমলের জানালা মত দেয়ালের গায়ে অলংকরণ এখানেও আছে। আর আছে থ্যাবড়ানো চার কোনায় চারটি স্তম্ভ। আরো একটি ব্যাপার এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মসজিদের গায়ের নানা কাজ ঝাড়খন্ড থেকে আনা কালো পাথর কেটে করা। ফলে এর স্থায়িত্ব অনেক নির্মাতার হিংসা উদ্রেককারী হওয়ার যোগ্য। মূল প্রার্থনা কক্ষের ডান কোণাতে আছে শাহী মঞ্চ যেখানে রাজকীয় অতিথিদের নামাজ আদায়ের আলাদা উত্থিত জায়গা সংরক্ষিত ছিল যা তাঁদের অনুপস্থিতিতে নারীরা অধিকার করত বলে ধারণা করা হয়। বাইরে উত্তর দিকে আছে মুয়াজ্জিনের আজান দেয়ার জন্য বিশাল মঞ্চ - যা সুলতানী আমলেরই আরেকটি বৈশিষ্ট্য। বাংলার সুলতানি যুগের দ্বিতীয় স্বাধীন সাম্রাজ্য তৈরি করা আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের আমল থেকে শুরু করে বহু ঘটনা ও মানুষের পদচিহ্নের সাক্ষী এ মসজিদ। স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই অতিনায়কের (বীরশ্রেষ্ঠ ক্যপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যিনি ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এবং ৭নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর নাজমুল হক যিনি ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের মাহাদিপুর থেকে নারায়নপুর পোস্টে আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন) অন্তিম শয্যা এই মসজিদ প্রাঙ্গণেই। এছাড়া প্রকৃত নির্মাতা ও তার পিতার কবর মসজিদ প্রাঙ্গন থেকে একটু বাইরেই কাল পাথরের আভরণে আবৃত। এই মসজিদ বহুলাংশে বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রধান যুগ নির্ধারণকারী প্রতিকৃতি। জ্ঞান-সময় উভয়ের অভাবেই চাঁপাইয়ের চারণা এখানেই শেষ করতে হয়। এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যে রক্তাক্ত ছিল তা বহুস্থলে মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষের গণকবর দেখলেই আঁচ করা যায়।
চাঁপাই যত না ইতিহাসের নবাব-সুলতানদের তার থেকে বেশি বর্তমান মানুষদের যাদের জীবন সংগ্রামে বদলে যাচ্ছে সমগ্র জনপদ- প্রতিদিন একটু একটু করে। মানুষগুলো সামান্য অমানবিক কিছু কাজ করতে গেলেও চোখের দিকে তাকাতে পারে না। সরলতা অনেকখানি ছেয়ে থাকলেও কঠোর জীবনাঘাত অনেকাংশেই তাদেরকে ছলনার দ্বারস্থ হতে বাধ্য করেছে। এটা অবশ্য বাংলার সকল মফস্বল এলাকার জন্যই খাটে বলে আমার বিশ্বাস। আমের উপর অতি নির্ভরশীলতা তাদের সাথে সাধারণ কথাবার্তাতেই উঠে আসে। যেকোন চাঁপাইবাসীর সাথে কথা বলতে গেলে ৩ থেকে ৪ বাক্য উভয় পক্ষ থেকে আদান-প্রদানের পরেই আমের কথা আসবে এটা সুনিশ্চিত। ইলামিত্র ও বেহুলা - দুই বজ্রনারীরই শ্বশুরবাড়ি যেখানে সে জায়গার ধৃতিক্ষমতা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। এখানকার খাদ্যের দাম কম জেনেই আসা হলেও খুব একটা যে কম তা বলা যাবে না। শহরে আলাউদ্দিনের বাংলা খাবার আঙ্গুল চাটতে বাধ্য করতে পারে অনেকের। কারো চাইনিজ খেতে মনে চাইলে সেই সুযোগও আছে স্টেশনের রোডের মোড়ে। আর চা টার কথা নাই বা বুল্লাম, দাদা!


তথ্যসূত্রঃ
১। দর্শনস্থলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড
২। বাংলাপিডিয়া 
৩। উইকিপিডিয়া 
৪। Discover the Monuments of Bangladesh : A Guide to their History, Location (Nazimuddin Ahmed)
৫। স্থানীয় মানুষ

Comments