ওমর খৈয়ামঃ নিশাপুরের উদাসীন কবি

Illustration by Adelaide Hanscom (c. 1910). [Source: Wikimedia Commons]

'ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস?-কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর?
ঘুম মৃত্যুর যমজ ভ্রাতা, তারসাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কবরে তোর জনম ভর।'
কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদ করা রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম বইটির এই তিন নম্বর চতুষ্পদীটি প্রথম আমার চোখে পড়ে দশ বছর আগে। এ ধরণের চিন্তা এভাবে প্রকাশ করাটা নিঃসন্দেহে তখন অভাবনীয় ঠেকেছিল। পুরনো,পোকায় কাটা, জরাজীর্ণ বইটি খুবই অদ্ভুত লেগেছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার সাথে পরিচয়ও সেই প্রথম-বইটির ভূমিকার মাধ্যমে। ঘুমালে আমাদের আত্মার কী হয় - দিনের এক তৃতীয়াংশ এর পেছনে ব্যয় করলে জীবনও যে এক তৃতীয়াংশ হারায় এসব কথা সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করা ভাবনার খোরাক বৈকি!

Omar Khayyam (1048-1131) [Source: Henry M. Jackson School of International Studies]

ফিটজেরাল্ড এই নিশাপুরের কবিকে বিশ্বদরবারে জনপ্রিয়তার মঞ্চে নিয়ে আসলেও তাঁর 'ক-দর' পারস্যে ছিল সেই দ্বাদশ শতক থেকেই। ছোট ছোট ভাবনা, অতীন্দ্রিয় কিছু জিজ্ঞাসা - এসবের ছন্দময় প্রকাশভঙ্গি রুবাই। চার পংক্তির হেয়ালি বলা যায়। কবি তাঁর প্রায় হাজারখানেক চতুষ্পদীতে অস্তিত্ব, ধর্ম, ঈশ্বর, বিরহ, ভালোবাসা, দর্শনসহ বহু বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। মজার বিষয় হল, তাঁর অধিকাংশ রুবাইয়ে শরাব বা মদের কথা থাকলেও সৈয়দ সাহেবের মতে তিনি ব্যক্তিজীবনে অতিশয় সংযমী ছিলেন।
'করব এতই শিরাজি পান, পাত্র এবং পরান ভোর
তীব্র-মিঠে খোশবো তাহার উঠবে আমার ছাপিয়ে গোর।
থমকে যাবে চলতে পথিক আমার গোরের পাশ দিয়ে,
ঝিমিয়ে শেষে পড়বে নেশায় মাতাল-করা গন্ধে ওর।'
কিংবা-
'‘রজব শাবান পবিত্র মাস’ বলে গোঁড়া মুসলমান,
‘সাবধান, এই দু-মাস ভাই কেউ করো না শারাব পান।’
খোদা এবং তার রসুলের ‘রজব’ ‘শাবান’ এই দু-মাস
পান-পিয়াসীর তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ ‘রমজান’?'
অথবা-
'এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর-হাতে মোর লাল গেলাস,
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলমানও–
করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ।'

এরকম রচনা তাঁর ভুরিভুরি। জীবদ্দশাতেই অবিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত হওয়ায় তিনি হজ্জ করতে যান সেই কালিমা ঘুচাতে। সফল হয়েছিলেন কিনা সে প্রশ্ন আজো করা যেতে পারে। ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড চলাকালীন সময়ে এরকম শুঁড়ওয়ালা লেখা ধর্ম বা উম্মাহ-কারো জন্যই হিতকর ছিলনা সেটা সহজেই অনুমেয়। তারপরও জরাথ্রুস্টবাদ হতে ধর্মান্তরিত মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠে এতখানি নৈরাশ্যবাদ, ধ্বংসাত্মবাদ, আবার অদৃষ্টবাদের সাথে সংশয়বাদিতা প্রকাশ করা সেই যুগে অনন্য। তাঁর ভাষার খেলা, কাব্যিক সৌন্দর্য - এসব নিয়ে মন্তব্য করার খেমতা এই অধমের নাই। কাজী থেকে শুরু করে শহীদুল্লাহ,নরেন্দ্র দেব, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, শক্তি চ্যাটার্জী, সিকান্দার আবু জাফরসহ অনেকেই বাংলাতে রুবাই অনুবাদ করলেও অধিকাংশ ইংরেজি থেকেই বাংলা করেছেন। ফলে প্রকৃত ফারসির রসোদ্ধার করতে সেই ভাষা জানা ছাড়া উপায় খুবই অল্প।
কবি হিসেবে বর্তমানবিশ্ব খৈয়ামকে চিনলেও তাঁর গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় দখল তৎকালীন সময়ে কিংবদন্তিতুল্য সেটাতে কারো দ্বিমত করার কথা না। ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানে বৃত্তের ব্যবহার থেকে শুরু করে সমান্তরাল রেখা নিয়ে ইউক্লিডের পর তাঁর কাজকর্ম বেশ কিছু জায়গাতেই দেখলাম বহু সুদূরপ্রসারী। এছাড়া তাঁর তৈরি করা জালালি বর্ষপঞ্জি বর্তমানে অনুসরিত গ্রেগরি ক্যালেন্ডার থেকে নিখুঁত বলে দাবি করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান স্টাডিস বিভাগ। এই জালালি ক্যালেন্ডারে ৩৩ বছরে অধিবর্ষ হিসেবের কথা ছিল যা চার বছরে একদিন বাড়ানো থেকে বেশি উপযোগী। ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদ এতোটা বিস্তৃত না হয়ে পারস্য সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকা জয় করলে হয়তো জালালি ক্যলেন্ডারই আমরা মানতাম। কে জানে!
হঠাৎ খৈয়াম নিয়ে বাক্যব্যয়ের কারন মূলত আজকের গুগল ডুডল। রাশিচক্র হিসেব করে বের করা জন্মদিন আজ খৈয়ামের। উদাসী, খেয়ালি, আপাতবিশ্বাসী এই মানুষটি সম্ভবত যে চতুষ্পদী দিয়ে সর্বাধিক পরিচিত তাই দিয়ে শেষ করি,
'চুমুকখানি লাল মদিরা আর গজলের একটি কিতাব,
জান বাঁচাতে দরকার মতো একটু খানি রুটি কাবাব,
তোমায় আমায় দুজনেতে বসে প্রিয়ে নির্জনেতে
এ সুখ ছেড়ে রাজ্য পেলেও কিছুতেই বলব না লাভ।' -ডঃ মুঃ শহিদুল্লাহ
'এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয় সাকি, তাহার সাথে এক খানা বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথে,
এই যদি পাই চাইব না তাখত আমি শাহানশার।' -কাজী নজরুল ইসলাম
'এই খানে এই তরু তলে
তোমায় আমায় কুতুহলে,
এ জীবনের যে কটা দিন
কাটিয়ে যাব প্রিয়ে।
সংগে রবে সুরার পাত্র,
অল্প কিছু আহার মাত্র,
আর এক খানি ছন্দমধুর
কাব্য হাতে নিয়ে।' -নরেন্দ্র দেব
Here with a Loaf of Bread beneath the Bough,
A Flask of Wine, a Book of Verse—and Thou
Beside me singing in the Wilderness— 
And Wilderness is Paradise enow. -E. Fitzgerald
(নজরুল কেন রুবাই অনুবাদে অগ্রগন্য, সেটা উপরের উদাহরনে স্পষ্ট বোধ করি। শহিদুল্লাহ চেয়েছিলেন আক্ষরিকতা, নরেন্দ্র ছন্দ আর ভাবের প্রগাঢ়তায় মূল খেই হারিয়েছেন আর বাকিরা ফিটজেরাল্ড ধরেছেন, খৈয়াম নয়)
Edward Fitzgerald (1809-1883)

Comments