গ্রন্থ আলোচনাঃ অপরাজিত
In each of us a child has lived and a child has died - a child of promise, who never grew up.পাঁচালীর নায়ক বালক অপুর বেড়ে উঠা, তাঁর স্মৃতিকাতরতা, তাঁর জীবন যুদ্ধে অবিরাম লড়ে যাওয়া, অপরাজিত-অদমনীয় জীবনস্পৃহা, চরম একাকীত্ব-দারিদ্র্যের মাঝেও জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া আর সবকিছুর উপরে বিভূতির প্রকৃতিপ্রেমের অনন্য স্বাক্ষর - এই হলো অপরাজিত।
পথের পাঁচালী ছাপাতে যে লেখককে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে, শেষে কিছু বন্ধুর সাহায্যে সে বইয়ের আত্মপ্রকাশ। অপরাজিত ছাপাতে তিনি পত্রিকা থেকে অনুরোধ পেয়েছেন। গুণমুগ্ধ পাঠকদের চিঠি পেয়ে হয়েছেন উদ্বেলিত। দিকে দিকে সেসবের কথা বলতেন গর্বভরে। এ পর্যন্ত পাঠে যদি হালকা কিছু অপূর্ব রায়ের গন্ধ পাওয়া গিয়ে থাকে, তবেই প্রমাণিত হয় বিভূতি ব্যানার্জির ছায়াই হচ্ছে অপু। ইছামতির পাড়ের অপূর্বকুমার রায়।
স্বভাবতই পাঁচালী পড়ার পর অপরাজিতের উপর আশা অনেক বেড়ে যায়। লেখকের অপরূপ মায়ায় গড়ে তোলা অপুর বড় হয়ে উঠা-তার জীবনের কথকতা কতটা মহান হয়ে উঠবে! বিভূতি মোটেও হতাশ করেননি। একইরকম যত্ন, একইরকম প্রকৃতির আবেশে তিলে তিলে কাহিনীর পাটোন্মোচন, দারিদ্র্যের রোমান্টিসিজম, সবকিছু ছাপিয়ে অপরাজিত জীবনের জয়গান - সব পুরোদমে উপস্থিত।
আর প্রকৃতির আবর্তন, জীবজগতের নিয়তচক্রের সাথে মানুষের যে গহীন সম্পর্ক উদ্ঘাটন, সাথে অনাদিকাল ধরে জীবনের পর্যায়ক্রমিক আবর্ত; পু্ত্রের স্থলে পিতা, পিতার স্থলে পুত্র - এসবের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন, তা বিভূতি করেছেন চিরচেনা ছোঁয়ায় আর অপরিসীম মায়ায়। এতো হাহাকার, এতো তৃষ্ণা, এতো দুঃখ, এতো ক্ষুধা, এতো রূপ, এতো মায়া-এসবের সুবিচার উপন্যাসে তো বিভূতি থেকেই পাই। যত দূরেই চলে যাক অপু-শত ইটপাথরের কাঠিন্যে, গহীন অরণ্যের বুকে, পাহাড়ি নদীর পাড়ে কোমল বনফুলের আবেশে, দর্শনীয় স্থানের মাঝে-সেখানেই অপুর হৃদয়ে থাকে সেই গ্রামের খোলা আকাশ, মাদকতাভরা মাটির গন্ধ, স্নিগ্ধ-কোমল বাতাসের ছোঁয়া। আজীবন ধরে শৈশবে ফিরে যাওয়ার আকুতি। মহৎ জীবনটাকে সে নতুন করে দেখতে শিখে, নশ্বর হয়েও অপারের মহিমা অনুধাবন করতে চায়। তাঁর দার্শনিক সত্ত্বা সকল আনন্দ-সকল সুখের মানে খুঁজে পায়। অর্থ-যশ থেকেও যে মহত্তর সার্থকতা জীবনে রয়েছে সেটার অনুধাবনই অপুর জীবনশিক্ষা।
"যে নিশ্চিন্দিপুর অপুকে বাল্যকালে কবি করেছিল, সেই গ্রামটিই বয়সকালে তাঁকে করল ভাবুক-দার্শনিক। দিল উচ্চতর জীবনের দিশা।"
এরই সাথে পাঠক অনুধাবন করে, কাজলের মাঝে ধীরে ধীরে কিভাবে পাঁচালীর ছোট্ট অপুর পুনরাবিষ্কার হয়। হরিহর রায়ের অনুভূতি অপু অনুভব করতে পারে। অপুর আরেকটি বিশেষ দিক হলঃ মা সর্বজয়ার প্রতি অপরিসীম দরদ। শহুরে শিক্ষিত হয়েও অপু ভুলতে পারে না মনসাপোতায় তাঁর দুখিনী মাকে। নিস্তরঙ্গ জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে সে জননীর শরণাপন্ন হয়, অসীম বিস্ময়ে নারীজাতির এ অনন্য রূপ সে ধীরে ধীরে অনুভব করে। কলেজের কষ্টের মাঝেও সুচিন্তিত পদক্ষেপ না নিতে পারার দুর্ভাবনা থাকলেও সে মাকে হতাশ করে না। নিশ্চিন্দিপুরে আমবাগান সে মায়ের স্বপ্নপূরণের জন্য কিনে ফেলে। মাতৃবিয়োগে উন্মাদপ্রায় দশায় পৌঁছলেও দর্শনযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ সেখান থেকেই। নারীর স্নেহময়ীর সন্ধান এখানেই পায় অপু।
না জেনে ভবিতব্য অর্ধাঙ্গিনীকে প্রথম দেখে অপুর মানসিক অবস্থার বর্ণনা বোধ করি কালিদাস, ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে নারীসৌন্দর্য বর্ণনায় অন্যতম প্রণিধানযোগ্যঃ
"Do they breed goddesses at Slocum Magna?"
অপু স্ত্রীর মাধ্যমে আবিষ্কার করে নারীপ্রেমের সর্বংসহা রূপ। অভিভূত হয়, আপ্লুত হয়। হয় প্লাবিত। ক্ষণস্থায়ী হলেও এই ঐশ্বরিক প্রেমের মধ্য দিয়ে সে জীবনের আরো বড় সত্য খুঁজে পায়। সেটা হল আবেগের মূল্য। খুব ছোট ছোট খুনসুটি, ছোট কিছু আক্ষেপ, ছোট কিছু মুহুর্ত তাঁকে আজীবন তাড়া করে ফেরে। আর ছোটবেলার লীলা তাঁর জীবনে আসে রহস্যময় প্রেমের পতাকা হিসেবে। সে এই সম্পর্ককে কোনভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। কিন্তু এর গভীরতা অনুভূত হয় প্রতি পদক্ষেপে। দূরে থেকেও কাছে থাকা, একটি দুটি শব্দে নৈকট্যের ছোঁয়া লাভ করা-এ আবেশ সাধারণ প্রেমের পরিচায়ক নয়। দূরত্ব-বিরহের মাঝে অপু নারীর মাঝে মায়াবতীর খোঁজ পায়।
শেষকালে রানুদির মাধ্যমে সে ফিরে পায় ভগ্নীস্বরূপ মায়া। নিজের পছন্দের সম্পদ কাজলকে রেখে অপু যখন সাগর-পাহাড়ের ডাকে দেশান্তরী হয়-তার ভরসার আশ্রয় ছিল এই রানুদি।
বন্ধুত্বের পরম পিপাসা সে মেটাতে পারে অনিল, প্রণব, দেবব্রতদের মাধ্যমে। মনের মিল, চিন্তার উৎকর্ষ আর ভাবের সাযুজ্য-এসবের উপর ভিত্তি করেই অপুর জীবনে আসে কিছু মহৎ বন্ধু। অনিলকে অকালে হারালেও প্রণব ছিল আজীবন। আর সেই সাথে সত্যিকারের বন্ধু সম্পর্কে শিক্ষা সে ধীরে ধীরে পেতে থাকে। দুধের মাছি ও সুখের পায়রাদের রেখে অপু আসল সোনা চিনতে শেখে বহু কষ্টে।
অপুর রুচিশীলতা এখানে চোখে পড়ার মত। দৈন্য-দারিদ্র্যকে ছাপিয়ে সে কিছুটা অহম নিতে শেখে। ছোট থাকার জায়গার হালকা শৌখিনতা না আসলে অপুর হয় না। না খেয়ে-পরে থাকলেও অপুর মুখচোরা স্বভাব যায় না। প্রবল আত্মসম্মান নিয়ে বেড়ে উঠে নায়ক অপু। এখানেই তাঁর চরিত্রের শক্তি। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব। নিজের শখের ভার নিজের বইতে শেখা-এ শিক্ষাই যে অমূল্য। তা অপু নিজে থেকেই শিখেছিল। প্রকৃতির কাছে শিক্ষিত অপু, অত সহজে হার মানা যে তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।
বিদ্যা আর ভ্রমণ পিপাসু অপুর দেখা মেলে সর্বদা। দর্শনের তত্ত্ব, ইতিহাসের রোমাঞ্চ, ভ্রমণকাহিনী-এসবে বুঁদ হয়ে থাকত অপু হরহামেশা। ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে পরলেও লাইব্রেরিতে এলেই চাঙ্গা হয়ে উঠত আমাদের নায়ক। দারিদ্র্য তাঁর মনের শুভ্রতা, আত্মার শুদ্ধতাতে আঁচড় দিতে পারে নি একটুও। যেখানেই গিয়েছে অপু, সেখানেই খুঁজে ফিরেছে মুক্তির পথ। আলোর দিশা। এখানেই অপরাজিত স্বত্বার জয়গান। এখানেই জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।
তাইতো অপু,সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের যে আত্মা, সে বলতে পারেঃ
I am the owner of the sphere
Of the seven stars and the solar year
Comments
Post a Comment