গ্রন্থ আলোচনাঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল
"মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়"
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের এই আপ্তবাক্যটি যেন খুব উজ্জ্বল ও জীবন্ত হয়ে দেখা দেয় শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসামান্য সুন্দর বইখানিতে। স্বপ্ন দেখা এক জিনিস আর তাকে বাস্তবায়িত করতে যা যা করা প্রয়োজন তার সাহস বুকে রেখে এগিয়ে যাওয়া এবং সবশেষে তার দরুন তা হাসিল করা অন্য জিনিস। স্বপ্ন দেখতে তাই যেমন সাহস লাগে, ঠিক তেমনি স্বপ্ন দেখার খোরাকও লাগে। স্বপ্নটা নিজের জন্য, অবশ্যই। কিন্তু দিনশেষে কার মুখে হাসি ফোটাতে পারলে পার্থিব কষ্ট বিনষ্ট হয়- তাও একটি মোক্ষম প্রশ্ন বৈকি! আর কি আশাতেই বা স্বপ্নের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলা - সেটাও যদি ঠিকমতো উদ্দিষ্ট না হয়, তবে গোড়াতেই গলদ থেকে যায়। তাই হয়তো গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেছেন-
"সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা
আশা তার একমাত্র ভেলা"
আদর্শ হিন্দু হোটেল প্রচ্ছদ [Source: rokomari.com] |
গল্পটা সাধারণ। আসলে অতি সাধারণ। হাজারি দেবশর্মা চক্রবর্তী নামক রসুই ব্রাহ্মণের কাহিনী এটি। তাঁর বিন্দু থেকে বৃত্ত হওয়ার সহজ একটি গল্প। সরল, সাধারণ বলেই মায়াটা এতো বেশি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সকল প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক যখন জমিদার/উচ্চশ্রেণীর বণিক/ধনাঢ্য সংগ্রামী অথবা রাজনীতি বা রোমান্স নিয়ে ব্যস্ত সেই যুগে বিভূতিবাবু নিয়ে এলেন নিম্নবিত্ত মানুষের গল্প নিয়ে। তাঁদের সংগ্রামের কথা নিয়ে। তাঁদের জীবনের ছোট-বড় বেদনা-আনন্দ নিয়ে। যদিও তিনি উচ্চগোত্রের (ব্রাহ্মণ) বাইরে খুব বেশি বিরাজ করেননি। তথাপি, তাঁর কলমে আপামর গ্রামীণ বাঙালি সমাজের যে উপস্থাপন হয়েছে তা সে সময়ে (দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে) দুর্লভ।
প্রকৃতির সাথে এমন নিবিড় যোগসাজশ বিভূতিবাবুই সবচাইতে চমৎকার করে দেখিয়েছেন। হাজারি ঠাকুর নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার বর্ধিষ্ণু রাণাঘাট রেল জংশনের ধারে হোটেলের পাচক। মাসে সাত টাকা মাইনে। থাকা খাওয়া হোটেলেই। মালিক ও হোটেলের ঝির কাছে প্রতিনিয়ত তিনি অপমানিত, লাঞ্ছিত হন। মালিক ও ঝিয়ের ব্যবহার ও বুদ্ধিতে তিনি নিজে অতিষ্ঠ তো হনই, তার সাথে খদ্দেরদের সাথে ব্যবহারে তিনি রুষ্টও হন। কিন্তু তিনি বেতনভুক্ত হওয়াতে প্রতিবাদ করতে পারেন না। হাজারি এ সময়ে ট্র্যাজিক হিরো। তাঁর স্বপ্ন একটাই সে নিজে একটা হোটেল করবে যেখানে খদ্দেরদের আরাম আয়েশই হবে মূল লক্ষ্য। তিনি অনেক কষ্টে, সময় নিয়ে রান্না শিখেছেন। যে একবার খায়, সে ভোলে না হাজারি ঠাকুরের রান্না। এই ব্যাপারটা তাঁকে আত্মবিশ্বাস জোগায়। কিন্তু সে গরিব বামুন। বাড়িতে টাকা পাঠাতেই হিমশিম খায়। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। চুরির মিথ্যা অপবাদে চাকরি চলে গেলে তিনি গোপালনগর বাজারে (মজার ব্যাপার হল, এই গোপালনগরেই বিভূতিবাবুর বাড়ি।) কুন্ডু বাড়িতে পাচকের কাজ করেন। তারপর আবার রাণাঘাটে এলে পুনরায় চাকরি পেয়ে যান আগের দোকানে। কিন্তু এবার তাঁর সংকল্প ভিন্ন। তিনি তাঁর বাড়ি গাংনাপুরের জমিদারের কাছ থেকে উদ্যম, ধর্ম মেয়ে কুসুম থেকে অনুপ্রেরণা ও মূলধন, জমিদারকন্যা রূপবতী অতসীর থেকে মূলধন ও সমীহ নিয়ে নিজের স্বপ্নের হোটেল খুলে বসেন। সাথী হিসেবে পান পূর্বের হোটেলের সহকর্মী মেদিনীপুরের বংশীঠাকুর ও তাঁর ভাগ্নেকে। হাজারি ঠাকুরের উদ্যম হলঃ তাঁর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হলেও এখনো স্বপ্ন দেখতে জানে, হাসি ফোটাবার লোক তাঁর জন্য আছে - মেয়ে আশালতা। অনুপ্রেরণা হলঃ তাঁর সততা আছে, রন্ধন শিল্পে তাঁর ওস্তাদি আছে, তিনি রান্নার কারনে সুবিখ্যাত, তাঁর মূলধন যোগানোর মানুষও আছে। আর আছে কিছু বঙ্গললনার অপার সমীহ ও ভালোবাসা। তাঁর যে স্বপ্ন, তা পূরণ করতে তাই চাই সাহস, বুদ্ধি, মেধা, অধ্যবসায় আর কিছু সঠিক মানুষের সঙ্গ। যার সবটুকুই তিনি ভাগ্যগুণে ও তাঁর ভালোমানুষির গুণে পেয়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গা থেকে। এই পাথেয় নিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' চালু করেন।
এরপর শুধু তাঁর উত্তরণ। সাফল্যলাভ করলেও তাঁর সরলতা এক বিন্দু কমে না। বরং আনুগত্য, স্বভাবসুলভ নম্রতা আর ঔদার্য যেনো বেড়ে যায়। এমনকি গোপালনগর যাবার পথে এক ঘোষবাড়িতে এক মেয়েকে দিয়ে আসা কথা রাখতে তিনি আবার ছুটে যান সেই গাঁয়ে। আর তাই তো তাঁর গুণে ও সুনামে তিনি ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি যেমন করতে থাকেন তেমনি পূর্ববর্তী সময়ে যাদের থেকে লাঞ্ছনা পেয়েছেন তাঁদের দুঃসময়ে সাহায্য করে অর্জন করেন শ্রদ্ধা। আর শেষ দিকে আসে গ্র্যান্ড ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়েতে খাবারের ঠিকাদারি প্রাপ্ত এক গুজরাটি কোম্পানির শাখা তদারকির কাজ। ব্যবসার নাড়ি নক্ষত্র আরো ভালোভাবে বুঝতে তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে পাড়ি জমান বোম্বেতে। এখানেই শেষ হয় এ গল্প।
পদ্মঝিয়ের চরিত্রটি প্রথমে আমাদের মনে বিষদায়ী বলে অনুভূত হলেও গল্পের প্রবাহে আমরা বুঝতে পারি তার এহেন আচরণের কারন। তথাপি একটি কটু সত্য আমাদের কাছে ধরা পড়ে। অর্থই সকল সম্মানের উৎস। আর এই বিষয়টি পদ্মঝি ও হাজারি ঠাকুরের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়। মনিবগোত্রীয় থাকার সময় যে পদ্মঝিয়ের অন্যায় অত্যাচারে হাজারি ঠাকুর বারবার জব্দ হত, এমনকি চুরির অপবাদ নিতে হয়েছিল, তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে হাজারি ঠাকুর তার থেকে প্রণাম পায়। এটি তাঁর কাছে চরম প্রাপ্য ও অর্জন বলে মনে হয়।
হরিচরণবাবু এ গল্পে হাজারি ঠাকুরের কর্মোদ্দীপনার অন্য পিঠ। হরিবাবু যখন পুত্রের মৃত্যুশোকে কাতর হয়ে বিশাল জমিদারির কোন গতি করার বা সম্পদ কাজে লাগানোর স্পৃহা পায় না সেখানে হাজারি ঠাকুর স্বপ্ন দেখে চলে। তাঁর স্বপ্নই তাঁকে প্রবীণ হতে দেয় না। সে থাকে নবীনের মত প্রাণচঞ্চল।
অতসী হাজারি ঠাকুরের জীবনে ধনের দেবী লক্ষ্মীর মত। অতসীর দেয়া দুশো টাকাই তাঁর প্রথম পুঁজি। টাকাটা নেয়ার জন্য সে হাজারি ঠাকুরকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এবং শেষ পর্যন্ত সে টাকা নিতে হাজারি ঠাকুর বাধ্য হয়। তিনি যেখানেই গেছেন, মেয়েদের এই অপূর্ব-সুন্দর মায়ায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আবার এই বিষয়টার উল্টোপিঠও তাঁর দেখা আছে। তাই তো তিনি অতসীকে বলেন,
"তোমরা মেয়েরা যদি ভালো হও তো খুব ভালো, আর মন্দ হও তো খুবই মন্দ"
এবার আসি, কিছু আলোচনায়।
লেখকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বোধ করি এটা দেখানো যে, একজন ভালো মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভালো মানুষ দ্বারা বেষ্টিত হবেন। আর সততা আদর্শের সাথে কিভাবে কন্টকাকীর্ণ জীবনে মাথা উঁচু করে চলা যায়। শত দুঃখ, লাঞ্ছনা, অপমান - মাথায় নিয়েও কিভাবে সত্যিকারের বড় মনের মানুষ হিসেবে জগতে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু হাজারি ঠাকুরের জন্য দুই তিনজন খারাপ মানুষ ছাড়া যতজনকে পেয়েছি সবাই নিখাদ ভালো মানুষ বা মানবিকতার উৎকৃষ্ট উপমা। ধনী বণিক থেকে শুরু করে হাটের ব্যবসায়ী, পথচারী, গাঁয়ের বধূ, প্রতিবেশী। ভাগ্যদেবী যেন সবকিছু হাজারি ঠাকুরের উন্নয়নে সাজিয়ে দিয়েছেন। সত্যি, সততা আর আদর্শের গুণে তাঁর এতদূর আসা তথাপি ভাগ্যের সুপ্রসন্নতা না হলে অন্যান্য অনেক গল্পের মত এই গল্পও হয়ত ট্র্যাজিক মোড় নিতে পারত।
পথের পাঁচালীর মত এই উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রে বিভূতিবাবুর মমতা অতটা দৃষ্ট হয় না। পুরোটাই যেন হাজারি ঠাকুরের জন্য। এক চরিত্রে যতখানি মায়া, যতখানি দরদ দেয়া প্রয়োজন-তার চেয়ে বেশিই আছে বোধ করি। এটা করতে যেয়ে তিনি হয়ে পড়েছেন অতিশয় সাদাসিধে ও সরল এক ব্যক্তি। আবার এই সরলতাই হাজারি ঠাকুরকে এতটা আন্তরিক করে তোলে আমাদের কাছে। এতটা ভালোবাসার চরিত্র হয়ে উঠে চূর্ণী নদীর ধারে বসে আকাশ কুসুম চিন্তা করতে থাকা এক সাধারণ রাঁধুনি।
এই কাহিনীর একটু পূর্বকথা পাওয়া যায় বিভূতিবাবুর দিনলিপি 'ঊর্মিমুখর' এর পল্লীভ্রমণে। বাগানগ্রামে যাওয়ার পথে এক ষাটোর্ধ বামুনের সাথে দেখা হয় তাঁর। "রংটা বেজায় কালো, হাতে একটা পোটলা, কাধে ছাতি...। ওরকম লোক আমার ভালো লাগে। সহজ সরল মানুষ, এমন সব কথা বলে যা আমি সাধারণত শুনি নে"। কথায় কথায় তিনি জানতে পারেন, এই লোকটির নাম 'হাজারি পরটা'। ভট্টাচার্য। কিন্তু পরটা বানানোর মুন্সিয়ানার জন্য তাঁর উপাধি পরটা। চাঁদপাড়া গ্রামে তাঁর খাবার হোটেল নিয়ে অনেক গর্ব তাঁর। তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছা তাঁর নিজের একটা হোটেল হবে।
এই চরিত্র যে বিভূতিবাবুকে ভালরকম নাড়া দিয়েছে তাঁর প্রমাণ এই উপন্যাস। হাজারি পরটার স্বপ্ন পূরণ না হবার ব্যঞ্জনা নিয়ে লিখেছিলেন ছোটগল্প 'শান্তিরাম' আর সেটার উপযুক্ত সমাপ্তি টেনে দিলেন 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' এর মাধ্যমে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় [Source: News Line BD] |
প্রতি পাতায় পাতায় যে মমত্ব ঢেলে দিয়েছেন বিভূতিবাবু তা থেকে এটাই মনে হয়, যে উনিশশো ত্রিশের দশকে এক সরল বামুনের বিশ্বাস আর ভালোবাসার জোরে স্বপ্নপূরনের গল্প শোনাচ্ছেন তিনি। চরিত্র আর উপন্যাসটাকে ভালো না বেসে থাকা অসম্ভব।
পড়ে মনে হল যেন হাজারি ঠাকুর আমাদের তাওয়িজম (লাওৎ সের দর্শন) শেখাচ্ছেন,
"I have only three things to teach you: Simplicity, Patience, and Compassion. These three are your greatest treasures."
- Lao Tzi
Comments
Post a Comment