বৌদ্ধ মতবাদ

বুদ্ধ কথাটার অর্থ হলো যিনি জেগে উঠেছেন, যিনি আলোকদীপ্ত হয়েছেন। মিলেনিয়াল ভাষায় WOKE এর মতো। কিন্তু ঠিক হালের হকিকত নিয়ে পূর্ণ ওয়াকিবহাল - সেই অর্থে না। এই বুদ্ধত্বের বিচরণ আরো ব্যাপক জায়গা জুড়ে।

সেপিয়েন্স বইয়ের কথা দিয়েই শুরু করতে হয়,

"It all started with the food surplus"

খাদ্য উৎপাদনের আয়াস চলে যাওয়াতে মানুষজন গড়ে তুলতে থাকে বড় বড় নগর, বসতি। দজলা-ফোরাত-সিন্ধু-গঙ্গা-হুয়াংহো-নীলের দুধারের উর্বর মাটিতে বিশেষত শুরু হয় সভ্যতার আয়োজন। ভারতবর্ষে তখন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য বলেই অধিকাংশ গবেষকের ধারণা। খাবারের চিন্তা ঘুচে গেলে দর্শন কপচানোর সময় পাওয়া যায়। কথাটা মিথ্যা না।

Gautam [Source: The Sentinel]

বুদ্ধাগমনের পূর্ববর্তী ভারতঃ

ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের (১৮০০-১৭০০ বিসিই*) পর যে আন্তঃগোষ্ঠী কোন্দলের সূত্রপাত হয় তার সাথে লৌহ যুগের শুরু হওয়াতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর্যরা বৈদিক ভাষায় (সংস্কৃত) লিখত ও কথা বলতো। তাই সেই থেকে বৈদিক যুগের শুরু। হিন্দু ধর্মের নামটাও ঠিক না, সেই হিসেবে। সিন্ধু>হিন্দু (পারস্যদের দেয়া নাম)। বরং এই ধর্মের নাম বৈদিক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। 

বৈদিক যুগে জাতভেদের চরম কড়াকড়ি ছিল। এর শিখরে অবস্থান করতো ব্রাহ্মণরা। তবে সেই সময়ে ব্রাহ্মণ কেবল জন্মানুসারে হতো না। দ্রাবিড় (অনার্য) জাতির মাঝেও যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতো ও মৌলিক তত্ত্বের অবতারণা করতো তাঁদেরকে ব্রাহ্মণ হিসেবে গণ্য করা হতো*। মূল আর্যরা তো আছেই। শিক্ষার অধিকার ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কেবল এই গোষ্ঠী কুক্ষিগত করে রাখাতে শুরু হয় প্রচন্ড ক্ষোভ। নিম্নবর্গের মানুষের সংখ্যাও বেশি ছিল। অসন্তোষ বাড়ে। সাথে প্রচুর ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত জনপদ থাকায় মারামারি-হানাহানি-যুদ্ধ লেগেই থাকতো। বেদ-উপনিষদের বাণী আপ্তবাক্য হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণরাও আর নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার-গবেষণাতে জীবনীশক্তি ব্যয় করা থেকে বিরত হয় (৯০০-৮০০ বিসিই*)।

১৬ মহাজনপদ (500 BCE) [Source: India the Destiny]

এভাবে ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিশাল ব্যবধান দেখা দেয়। রাজ্য শাসন ও যুদ্ধে যেতো ক্ষত্রিয়। ধর্ম-কর্ম করতো ব্রাহ্মণ। ব্যবসা করতো বৈশ্য। আর ব্যাগার খাটতো শূদ্র ও অচ্ছুৎরা। আবার, সেই সময়ে লোহার ব্যাপক ব্যবহারে কৃষির উন্নতি হওয়ায় ব্যবসা-বানিজ্যেও আসে বিপুল সাফল্য। আলাদাভাবে ক্ষমতাশালী বণিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। ফলে সমাজের তলানিতে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্ররাই পড়ে থাকে। ইতোমধ্যে আর্যদের দ্বারা এক বিশাল অনার্য জনগোষ্ঠী সিন্ধু-গঙ্গার অববাহিকা থেকে পূর্বে ও দক্ষিণে নির্বাসিত হয়। যারা ছিল তারা উচ্চ-বর্ণের বৈদিক জনগোষ্ঠীর সেবায় নিয়োজিত ছিল।

উল্লেখ্য, এই সামাজিক অস্থিরতা কেবল ভারতেই ছিল তা নয়। চীন, মধ্যপ্রাচ্য (আরব-লেভান্ট-মেসোপটেমিয়া), পারস্যসহ সকল সভ্যতার আঁতুড়ঘরে দেখা যাচ্ছিল। সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব, যুদ্ধবিগ্রহের পেছনে অতিরিক্ত খরচ, ক্ষমতার প্রচন্ড এককেন্দ্রিকতা, সম্পদের বিষম বন্টন। এই বিষয়গুলো প্রকট হওয়ার সাথে সাথে কনফুসিয়ান, লাউৎসু (চীন), জরাথ্রুস্ট (পারস্য), ইহুদি নবী (মধ্যপ্রাচ্য)দের মতো মহৎ সমাজ সংস্কারকরা আবির্ভূত হন। ভারতে দেখা দেন মহাবীর ও গৌতম। সকলেই একটি বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে, এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে নৈতিকতা ও সমাজের সংস্কার দরকার। এদের সকলের মাঝে গৌতমের শিক্ষা সবচেয়ে সফল কেননা তাঁর প্রচারিত উপদেশাবলি যে ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল তা আজো কোটি কোটি মানুষ মেনে চলছে। আর শান্তির বাহকরূপে পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে মানা হচ্ছে।

বৈদিক যুগের অন্যান্য সন্ন্যাসী গোষ্ঠীঃ

সন্ন্যাসের মাধ্যমে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা গৌতমই প্রথম প্রচলন করে, তা না। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণদের সাথে বৈষম্য বেড়ে যাওয়াতে বেশ কিছু মানুষ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে দূরে চলে গিয়ে বনে বা শহরের বাইরে মাঠে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধ্যানে মগ্ন হতে থাকে। এই চর্চা বেশ কয়েকশ বছর ধরেই চলছিল। বৈদিক ধর্মেও এই প্রথা ছিল। পাশাপাশি আরো কিছু ধর্মগুরু তাঁদের স্বতন্ত্র দর্শন নিয়ে আলাদা সংঘ গড়ে তুলেন। সেসবের প্রভাব সেই যুগে মোটেও কম ছিল না। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবাই মোটামুটি একদিক থেকে একই পথের পথিক ছিলেন-বৈদিক গ্রন্থের অসাড়তাতে বিশ্বাসী হয়ে মনের প্রশান্তি অর্জনের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন। সেইসব দলগুলোর মধ্যে বড় ও প্রভাবশালী ছিল বলা যায় নিচের দলগুলোকে।

অজীবকঃ- নিয়তিবাদী নাস্তিক। এই নামটি এসেছে 'অজীব' বা জড় থেকে। গৌতমের সমসাময়িক এদের উত্থান এবং বৈদিক বিরোধী সামাজিক আন্দোলনে বুদ্ধবাদের পরই এদের স্থান ছিল। তাঁদের মতে, জগতের সবকিছু ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই কর্ম নিষ্প্রয়োজন (অক্রিয়া)। কেননা যে কর্মই করা হোক না কেন, নিয়তি বদলানো সম্ভব না। আবার তাঁরা নৈতিক কার্যকারণকে নাকচ করে দেয়। মানে কোন কাজের জন্য কোন কারণ দরকার পড়ে না বা এর থেকে কোন ফলাফল আসে না। কারণ, সবকিছুই তো ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

তাঁদের মতে, আত্মার স্থানান্তর ঘটে এবং এই চক্রের শেষ স্তর হলো অজীবক সন্ন্যাসী। তবে এর জন্য সময় লাগে লাখ লাখ বছর। কারণ প্রতিটি আত্মা যতগুলো জীবন ধারণ সম্ভব সগুলো পার হয়ে যায়। খুব সম্ভবত, এই অবান্তর বড় সংখ্যার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে আল বিরুনীর ভারততত্ত্ব বইয়ে। তাঁদের মতে জগৎ সংসার ৭টি উপাদান নিয়ে গঠিত- মাটি, পানি, বায়ু, তাপ, সুখ, দুঃখ, আত্মা (বা জীবন/'জীব')।

অজীবক ধর্মমত হাজার বছরের উপর ভারতে বিস্তৃত ছিল। ভারতের দক্ষিণ, উত্তর ও পূর্বাংশে এদের বিচরণ বেশি ছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা।

লোকায়ত বা চার্বাকঃ- বস্তুবাদী বা জড়বাদী নাস্তিক। প্রকৃতিবাদ এই দর্শনের মূলমন্ত্র। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবেই এই চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। চার্বাক দর্শন এখানে আলোচ্য সকল দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। বেদ-উপনিষদ, মহাভারতেও লোকায়তের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, সকলের যা খুশি তা করার অধিকার আছে। কোন কিছুই ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিগুলো যাবতীয় সুখ-শান্তির উদ্দেশ্য। ফলে জীবনে পার্থিব সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দর্শনকে যদৃচ্ছাবাদও বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, কাম বা যৌনতৃপ্তি সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ বলে মানা হয় এই দর্শনমতে। যেহেতু মৃত্যুর পর কোন জগৎ নেই তাই যত ভোগ-বিলাস, আনন্দ তা এই জগতে করে নেয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। আর সেই হিসেবে একেকজন মানুষের জীবনে দুঃখ-দুর্দশার চেয়ে সুখের পরিমাণ অনেক বেশি। আবার চার্বাকপন্থিরা নৈতিক কার্যকারণকে (সবকিছু ঘটা বা হওয়ার পেছনে কোন না কোন কারণ আছে) অস্বীকার করে অজীবকদের মতই কিন্তু অন্য কারণে। তাঁদের মতে, সবকিছুতে যেহেতু যা খুশি তাই করার ইচ্ছা আছে তাই কোন ঘটনা বা কাজের জন্য কোন কারণ বা উদ্দেশ্য থাকার দরকার নেই। তাঁদের মতে, বিশ্ব জগৎ চারটি উপাদান নিয়ে গঠিতঃ- মাটি, পানি, বায়ু ও তাপ/আগুন। 

এই চিন্তাধারা বর্তমান জগতেও নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। এই জীবনটাকে পুরোপুরিভাবে উপভোগ করে নেয়ার দর্শনের যে নতুন যুগ শুরু হচ্ছে তার মূল কিন্তু এই লোকায়ত চিন্তাধারায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে তোড়জোড়, কোন বিষয়ে সমালোচনা গ্রাহ্য না করা কেননা সবারই যা খুশি তাই করার অধিকার আছে, সবকিছু মিলিয়ে এক জীবনের নেশায় সব নৈতিক-মানসিক বিষয়গুলাকে গিট্টু পাকায় ফেলা - এসব নব্যচার্বাকবাদ নয় তো কি?

সংশয়বাদীঃ- এই মতবাদধারীরা বিশ্বাস করতেন, কোন মতবাদ বা কোন বিশ্বাস নিয়েই কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না। সব যুক্তি-তর্ক বেকার খাটনি। তাই তাঁরা সাধারণত বিতর্ক এড়িয়ে চলত বলে সেই সময়ের বইগুলোতে বলা হয়েছে। এই মতবাদের খুব বেশি প্রসার দেখা যায় নি। যদিও এই দর্শন এখনো কিন্তু টিকে আছে। শুধু প্রচার-প্রসার নেই। কেননা বিতর্কের খাতিরে গলা ফুলাতেই তাঁরা আগ্রহী নয়। কারণ তাঁরা এটাতেই নিশ্চিত হতে পারে না যে কোনটা আসলে ঠিক বা কোনটার দিকে যুক্তি ভারি। দোটানায় থাকার কারণে এ চিন্তাধারার স্ফুরণ সেভাবে হতে পারে নি।

জৈনঃ- কার্যকারণে বিশ্বাসী এবং নাস্তিক আরেকটি দল হল জৈন। তাঁদের ঠিক সেভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলেও স্বর্গীয় সত্তাতে তাঁদের বিশ্বাস আছে। এরা বিখ্যাত এবং এখনো টিকে আছে। তারা বৌদ্ধদের মতো কার্যকারণে বিশ্বাসী। যদিও ধারণা করা হয়, এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে অজীবক দর্শন থেকে মহাবীর আলাদা হয়ে আসার পর। তারপরো তাঁদের মাঝে বুদ্ধসুলভ কিছু দর্শন বিদ্যমান। তাঁরা কর্মফলে বিশ্বাসী। তাঁরা প্রচণ্ড পরিমাণে নিরামিষাশী। সত্যিকার অর্থে তাঁরা বুদ্ধদের থেকেও বেশি কঠোর এই দিক দিয়ে। তাঁদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, নিজের উপর অত্যাচার। জন্মের যে আবর্তে মানুষ ঘুরপাক খায় সেখানে কোন জন্মে করা খারাপ কর্মের ফল এই জীবনে পুষিয়ে দিতে হলে চরম মাত্রায় নিজের উপর অত্যাচার চালাতে হবে। তবেই মিলবে মুক্তি। টানা উপবাস বা খুব কম আহার  (প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জৈন ধর্ম গ্রহণ করে শেষ জীবনে কঠোর উপবাসে মৃত্যুবরণ করেন), সুতীব্র সন্ন্যাসব্রত, স্থাবর সকল সম্পত্তির বিসর্জন - এগুলো তাঁদের আচারের মধ্যে পড়ে। তাঁদের দর্শনের একটি বড় দিক হল - কোন জীবের তিলমাত্র ক্ষতি না করা। তাঁদের কাজকর্মের বিবরণে মনে হতেই পারে তারা বুঝি চরমপন্থি সন্ন্যাসী। কিন্তু আসলে মোটেও তা নয়। বরং তাঁরা চরমপন্থার বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার ছিল। তাঁদের দুটি প্রধান শাখা আছে যারা মূলত সত্য সন্ধানের জন্য সন্ন্যাস ব্রত কীভাবে পালন করা উচিৎ, নারীদের মোক্ষলাভের গ্রহণযোগ্যতা, মন্দির ও প্রতিমার গঠন-সুরত এবং পালনীয় তীর্থঙ্কর ও গ্রন্থের ভাগে বিভক্ত। দিগম্বর (উলঙ্গ অবস্থায় সন্ন্যাস) ও শ্বেতাম্বর (সাদা পোশাকে সন্ন্যাস)। বৌদ্ধ মতের মত জৈন ধর্মে যারা মোক্ষ লাভ করে তাঁদেরকে আরিহৎ বলা হয়। আর যুগে যুগে জৈনদের পথ দেখাতে আবির্ভূত হন তীর্থঙ্কর। যেই ধারার প্রথম ছিলেন ঋষভ। তেইশতম ছিলেন পরশ্ব, যার অস্তিত্বের প্রমাণ ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে (চিত্র, ভাস্কর্য, পুস্তক) মেলে। আর সর্বশেষ ছিলেন মহাবীর। পর্যুষণ/দশ লক্ষণ তাঁদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এ সময়ে তাঁরা উপবাসসহ নানা আচার পালন করে পুণ্য কামিয়ে নিতে ব্রতী হয়। দেরাসর বা বসডিতে (জৈন মন্দির) সেসময় জমায়েত হয় ধর্মপ্রাণ জৈনদের। তাঁদের মূল পাঁচটি ব্রত হলঃ 

১। অহিংসা 

২। সত্য

৩। অস্ত্যেয় বা অচৌর্য (চুরি না করা)

৪। ব্রহ্মচর্য (কুমারব্রত)

৫। অপরিগ্রহ (সম্পদ ধারণ না করা)


এ তো গেলো বুদ্ধের আবির্ভাবের পেছনে সামাজিক প্রভাব ও কিঞ্চিৎ ইতিহাস। বুদ্ধের দর্শনের আলোচনার আগে তাঁর জীবন নিয়ে কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এটি নিয়ে বিশদ বই-পুস্তক, উইকিপাতা আছে। আমি দর্শনের আলোচনার জন্য জরুরি বিষয়েই আলোকপাত করবো বেশি।


বুদ্ধাগমনঃ

শাক্যগোষ্ঠীর হিমালয়ের কাছের এক রাজ্যের রাজা শুদ্ধোধনের ছেলে সিদ্ধার্থ (সর্বার্থসিদ্ধ-এর সংক্ষেপিত রূপ)। তাঁর জন্মকালেই জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন যে, এই ছেলে জগতের ভোল পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তাঁকে দিয়ে রাজ্যের হাল ধরাতে চাইলে তাঁকে সর্বদা চারটি দৃশ্য হতে দূরে রাখতে হবে-     

১) বার্ধক্য, 

২) রোগ,

৩) মৃত্যু, এবং

৪) সন্ন্যাস।


Buddha Seeing Four Sights (Clockwise from top: Sickness, Death, Asceticism, Oldness) [Source: Gauthama Buddha Blogspot]

এই চারটি বাস্তবতা হতে দূরে রেখে যাবতীয় পার্থিব ভোগ-বিলাসে মত্ত রাখতে পারলে গৌতম একসময় রাজ্যভার গ্রহণ করবে ও দিগ্বিজয়ী রাজা হয়ে উঠবে। রাজা শুদ্ধোদন তাঁর সাধ্যমতো সকল ব্যবস্থা পুত্রের জন্য করেছিলেন। ২৯ বছর সিদ্ধার্থ এর মাঝে ডুবে ছিলেন। তাঁর তিন ঋতুর জন্য তিনটি প্রাসাদ ছিল। ভোজন-কাম-শারীরিক ক্রীড়াসহ যাবতীয় বিলাসের আয়োজন তাঁর জন্য ছিল। কিন্তু একদিন তাঁর সামনে বাস্তবতা চলে আসে। তিনি ধীরে ধীরে চারটি দৃশ্যের সবকটির দেখে ফেলেন এবং এর পরিচয় পেয়ে যান। ইতোমধ্যে তিনি বিয়ে করেছিলেন ও রাহুল নামের সন্তানও ছিল তাঁর।

এখানে একটি জিনিস উল্লেখযোগ্য যে, গৌতম গৃহত্যাগের আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় জুড়েই রণকৌশল, রাজনীতি তথা রাজ্যচালনার রীতিসহ বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। এবং শুদ্ধোধন এর জন্য চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেন নি সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তাঁর জীবনকাল ৫৬৬ খ্রি.পূ.  থেকে ৪৫৬ খ্রি.পূ. ধরা হয়।* গৃহত্যাগ ৫৩৭ খ্রি.পূ. তে।*

গৃহত্যাগ ও নির্বাণঃ

এরপর কোন এক রাতে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি ঘর ছাড়েন। সন্ন্যাসব্রতের শিক্ষা নেন দুই গুরু থেকে। কিন্তু সন্তুষ্টি আসে না তাঁর। নিজের উপর অত্যাচার করে সন্ন্যাসব্রতের ধারণার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেন (জৈন মতবাদের অন্যতম প্রধান কথা এটি)। তাঁর সমসাময়িক জৈন, অজীবক (ভাগ্যবাদ, তথা নিষ্কর্মবাদ), চার্বাক (নিরীশ্বরবাদ, প্রমাণসর্বস্ব), সংশয়বাদী - মতবাদগুলো তাঁর মতে সত্যপথের সন্ধান দিতে পারে না। তিনি কিছু ধারণার শুরুর দিককার শিক্ষা পেয়ে যান দুই গুরু থেক।

ঘর ছেড়ে দেয়ার পর পরই তাঁর সাথে দেখা হয় আরাদা কালামের। এই সাধু পুরুষ গৌতমকে কৌমার্যের শিক্ষা দেন। আর সেই সাথে আরাদার কাছ থেকেই গৌতমের শূন্যতা বা অস্তিত্বের না থাকার ধারণা জন্মে। এই শূন্যতার ধারণা আবার একেবারে অস্তিত্বহীনতার কথা। 'আমি নাই', 'তুমি নাই', 'কিছু নাই' রকমের কথাবার্তা। আরাদার কাছে তিনি খুব শীঘ্রই এই পাঠ চুকিয়ে নেন। শিক্ষক এতে অভিভূত হয়ে তাঁর দলের অধিপতির পদে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু গৌতম এতে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এই তীব্র অস্তিত্বহীনতার বুলি তাঁকে মন থেকে সায় দেয় না। তার উপর এই শিক্ষা গৌতমের কাছে কিছুটা সংকীর্ণ চিত্তের মনে হয়। তারপরও এই শিক্ষা তাঁর নির্বাণ পাওয়ার সফরে অনেক সাহায্য করেছিল বৈকি!

এরপর গৌতম উদ্রক রামপুত্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই গুরু তাঁকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বস্তুর উপলব্ধির শিক্ষা দেন। কীভাবে নানা জিনিসের অস্তিত্ব সম্পর্কে দেখে-শুনে-চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তে আসা লাগে - এই শিক্ষা পান তিনি উদ্রক থেকে। এটিও তিনি খুব দ্রুত আয়ত্তে নিয়ে আসেন। এই গুরুও একই প্রস্তাব দিলে গৌতম সেটিও ছেড়ে দেন। যোগ দেন আরো পাঁচজনকে নিয়ে কিঞ্চিৎ চরমরূপে সন্ন্যাসব্রতে। 

একটি চালের দানায় এক দিন। এই ছিল এই সময়টায় তাঁর আহারমন্ত্র। শরীরের উপর অত্যাচার করেও তিনি খুব একটা লাভবান হচ্ছিলেন না। সত্যের জ্ঞানলাভ দূরেই থেকে যাচ্ছে বলে তাঁর মনে হতে লাগলো। ফলে তিনি এই সঙ্গ ত্যাগ করে আহারের এই চরম নিয়ম ত্যাগ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলেন। এবং বর্তমানে গয়াতে (তৎকালীন উরুবিল্ব) বিখ্যাত বোধিবৃক্ষের (অশ্বত্থ বট) নিচে তপস্যায় বসে যান। 

এখানেই গৃহত্যাগের ৬ বছরের মাথায় তিনি লাভ করেন নির্বাণ*। মহাজ্ঞান। গৌতম হয়ে উঠেন বুদ্ধ। সংসারে জীবনচক্রের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন। মোক্ষ লাভের দ্বার তাঁর কাছে খোলা। এই জ্ঞান বৃহত্তর মানব কল্যাণে ছড়িয়ে দিতে হবে - এই ধারণাটা আসে ব্রহ্মা থেকে। প্রথমে বুদ্ধ সন্দেহ পোষণ করছিলেন যে, এই জ্ঞান কি জগতের মানুষ নিতে পারবে কিনা। বৈদিক ধর্মের সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা স্বয়ং প্রকট হয়ে বুদ্ধকে এই বিদ্যার প্রচারে ব্রতী হতে অনুরোধ করেন।  

এরপর তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তাঁর লব্ধ জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বোধিসত্ত্ব এমন একটি সত্তা যিনি পরম জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু তাঁরা সেটি সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ না করে পরিনির্বাণ গ্রহণ করেন না। মানুষের জন্য মমত্ববোধ থেকে তিনি নির্বাণ লাভের শিক্ষা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে কিছুকাল দুনিয়াতে থেকে যান। তাঁর এই ত্যাগস্বীকারের জন্য তিনি মহৎ রূপে সকলের নিকট পরম শ্রদ্ধার পাত্র। আর গৌতম হলো বোধিসত্ত্বের ধারার এক বুদ্ধ। শাক্যমুনি বুদ্ধ। 

কোন ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য যে অবশ্য পালনীয় নিয়ম-নীতি, আচার-বিধি থাকে, তেমন কিছুই তিনি বলেন নি। কেবল সকলকে দিতে চেয়েছেন দুঃখ হতে মুক্তি। নির্বাণের পথ। একটি সত্য, সহজ দর্শন। 

তাঁর দেখানো পথের এই এক অদ্ভুত সুন্দর এক দিক। কোন সঠিক-বেঠিকের বিচার তিনি করতে যাননি। তিনি বাস্তবিক ও লাভজনক পথের দিশা দেখিয়েছেন। ঠিক-ভুলের হিসাব করতে গেলে তো তাঁর কথা ধর্মই হয়ে যেত। যেখানে একেকটি বানী একেকটি আপ্তবাক্য হয়ে উঠে। বুঝার আগে মেনে চলা চলে আসে। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর দর্শন ধর্ম না হলেও শীঘ্রই তা নিয়ম রীতির জালে পড়ে ধর্ম হয়ে উঠে। অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার ফলে কেবল মুখে মুখে মনে রাখা তত্ত্বকথায় সবার কাছে বুদ্ধের কথা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। তৈরি হয় লিখিত গ্রন্থ। শুরু হয় বিভাজন*। 


ধর্মবিভাজনঃ

তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকশ বছর পরে তাঁর দর্শন পরিপূর্ণ একটি ধর্ম হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ত্রিপিটকের তিনটি পিটকের [সূত্র (এখানে বুদ্ধের বক্তৃতা সন্নিবেশিত হয়েছে), বিনয় (এখানে সংঘের মেনে চলা উচিত এমন নীতির উল্লেখ আছে যা তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল), অভিধর্ম (তাঁর বানীর তর্জমা)] মাঝে একটিতে (বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট!) গণ্ডগোল লেগে যায়। সংস্কৃতজাত পালি ভাষার ত্রিপিটককে প্রাচীন ধরা হয়। আর দেড়শ-দুশো বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর তিব্বতি ও চৈনিক ভাষাসমূহের অনুবাদের মাধ্যমে আধুনিকতম কিন্তু সবচেয়ে বিখ্যাত ধারার উন্মেষ ঘটে। এছাড়া জাতক আরেকটি খুবই জনপ্রিয় গ্রন্থমালা। এখানে বুদ্ধের আগের অনেকগুলো জন্মের বৃহৎ ও সু-উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ দিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে। বানরদলের নদী পার হওয়া, বনে ক্রুদ্ধ রাজার সামনে ধ্যানমগ্ন সাধকের ধৈর্যের পরীক্ষা - এগুলো বিখ্যাত।    

প্রথম দিকে ১৮/২০ টি বৌদ্ধমতধারার প্রচলন ছিল*। তবে মূল বিভাজন দুই শাখায়। তবে এদেরও বহু শাখায় বিভাজন ছিল এবং আছে।

১। মহাসাংঘিক। এর থেকে মূলত মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধমতবাদের সৃষ্টি। তাঁদের মূল মত হল গৌতম একজন অতিমানব যিনি স্বর্গ থেকে জগতের কল্যাণে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাছাড়া মহাযান ও বজ্রযান মতধারা অনুযায়ী, যে কেউই বোধিসত্ত্ব অর্জন করতে পারে। আর এই অর্জনের পর মানবজাতির উপর দয়াপরবশ হয়ে তাঁদের উচিৎ যতদিন সম্ভব পরিনির্বাণের জন্য বিলম্ব করা। যাতে সাধারণের কাছে এই প্রজ্ঞাপারমিতা (অভিজ্ঞান) পৌঁছিয়ে দিয়ে যেতে পারে।

চীন-জাপান-মঙ্গোলিয়াতে এর প্রচার মূলত বেশি। পশ্চিমা বিশ্বে এই মতবাদের জনপ্রিয়তা বেশি।

২। স্থবিরবাদ। এর থেকে মূলত থেরোবাদ বৌদ্ধমতবাদের সৃষ্টি। তাঁদের মতে, গৌতম সাধারণ মানুষ। কিন্তু কঠোর তপস্যা, গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির বলে তিনি অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলেন। এই মতানুসারে, বোধিসত্ত্ব পেতে হলে সন্ন্যাসব্রত নেয়া ছাড়া আর উপায় নেই। আর এর অর্জনের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত কঠোর সন্ন্যাস উদ্যোগ। অরহৎ হয়ে গেলে কাউকে বলাটাও উচিৎ না বলে এই মতবাদমতে মেনে নেয়া হয়।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এ মতের অনুসারী বেশি।

এছাড়া আরো কিছু মৌলিক বিষয়ে এই দুই মতবাদের বিরোধ আছে। যেমনঃ 

  • অরহৎ (নির্বাণ প্রাপ্ত তপস্বী) হবার পর কারো পক্ষে নৈতিক স্খলন সম্ভব কিনা, [স্থবিরবাদঃ সম্ভব] 
  • অভিধর্ম অংশের নানা আলোচনা, [সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বিস্তৃত অভিধর্ম পিটকের অধিকারী স্থবিরবাদ]
  • পুদ্গাল বা ব্যক্তির অস্তিত্ব ও স্কন্ধ বা ব্যক্তির ধ্যানধারণার মধ্যে কোনটি এক সত্তা হতে আরেক সত্তায় স্থানান্তরিত হয়, [স্থবিরবাদঃ ব্যক্তির কোন অস্তিত্বই নেই]
  • নৈতিকভাবে ভালো-মন্দ ছাড়া কাজের আর কোন ধরনের ফলাফল হতে পারে কিনা, [স্থবিরবাদঃ হয়, নির্লিপ্ত বা উদাসীন]
  • সত্যের প্রাপ্তি কি তাৎক্ষণিক নাকি ধীরে ধীরে তা অর্জিত হয়, [স্থবিরবাদঃ তাৎক্ষণিক]
  • সৎকর্ম কি অজান্তেই তৈরি হয় নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে জোর চেষ্টার দরকার হয় [স্থবিরবাদঃ ইচ্ছা করে, জোর করে তৈরি করতে হয়] ইত্যাদি।

বর্তমানে অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বৌদ্ধ মতবাদ বিভাজিত থাকলেও মূল ভাগ তিনটিকেই ধরা হয়। 
  1. মহাযান
  2. থেরোবাদ
  3. বজ্রযান
 Major Types of Buddhism [Source: Study Buddhism]



Timeline of the Spread of Buddism [Source: Pinterest]


Comprehensive Divisions of Three Major Sects of Buddhism [Source: Pinterest]


বর্তমানে সাধারণের মাঝে বৌদ্ধ ধর্ম বলতেই যে চেহারাটা ভেসে উঠে তিনি হলেন দালাই লামা। মজার ব্যাপার হলো, ইনি কিন্তু বজ্রযানী বৌদ্ধের তিব্বত শাখার গেলুগ উপশাখার ধর্মীয় প্রধান। এবং বজ্রযান বিভাগ পুরো বৌদ্ধ জনসংখ্যার মাত্র ৬%*।

গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাঃ


এক কথায় বলতে গেলে, বুদ্ধের শিক্ষা আত্মোপলব্ধির। তাঁর শিক্ষা শান্তির। তাঁর শিক্ষা মুক্তির।
তিনি মধ্যমপন্থা অনুসারী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। শ্রেষ্ঠত্বের বিচার আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর মধ্যমপন্থী চিন্তাধারা অনেক ক্ষেত্রেই যুগান্তকারী হিসেবে মেনে নেয়া যায় সেই সময়ের হিসেবে। এমনকি এই যুগে এসেও।
তিনিই বিশ্বে প্রথমবারের মত দর্শনেহেতু বা কারণের ধারণার অবতারণা করেন। যেকোন ঘটনা বা অস্তিত্বের পেছনে কারণ বিদ্যমান। এটা গৌতম বুদ্ধের অন্যতম আবিষ্কার। আবার সেই কারণ উদ্ঘাটন করে তার সমাধানের পথও তিনি বাতলে দিয়েছেন। 

ये धर्मा हेतु-प्रभवा हेतुं तेषां तथागतो ह्यवदत्
तेषां च यो निरोध एवं वादी महाश्रमण

 

"ইয়ে ধারমা হেতু প্রাভাবা হেতুম তেষাম তাথাগাতো হ্যা ভাদাৎ,  
তেষাম চা ইয়ো নিরোধা য়েভাম বাদি মাহাশ্রামাণাহ্‌"

 

"Of those phenomena which arise from causes:
Those causes have been taught by the Tathagata (Buddha),
And their cessation too - thus proclaims the Great Ascetic."

তাঁর শিক্ষার প্রথম ধাপ ও মূল তিনি চারটি সত্য বা চারটি আপ্তবাক্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। এই চার সত্যের বিষয়টা অনেকটা চিকিৎসাবিদ্যার মত। প্রথমে সমস্যা বিদ্যমান - এটা স্বীকার করে নেয়া, তারপর এর মূল খুঁজে বের করা, তার থেকে এর হতে নিস্তার লাভ করার পথ বের করা।

১। দুঃখ-দুর্দশা জীবনের চরম সত্য। (Dukkha) জন্ম-দুঃখ-মৃত্যু এই তিন সত্য জীবনের।
২। এই দুঃখ-দুর্দশার কারণ খুঁজে বের করা সম্ভব। (Samudaya) যা মূলত পাবার আকাঙ্ক্ষা। 
৩। এই দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি সম্ভব (নির্বাণ প্রাপ্তি) (Nirodha)
৪। এই চক্র হতে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা কুশলতার সাথে অবলম্বন করতে হবে। (অষ্টমার্গ) (Magga)



এই চারটির পূর্ণ অনুধাবন ও জীবনে সঠিক চর্চা নির্বাণ দিতে পারে। নির্বাণ লাভই একজন মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সাফল্য।


নির্বাণ কী? বুদ্ধ দর্শনের মূল লক্ষ্য


The Fruit of the Homeless Life: Bhikkhu Silachara তে একটি গল্প আছে যে, 
"এক রাজা একবার বুদ্ধকে প্রশ্ন করেছিল, 'এক সাধকের সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায় কী?' বুদ্ধ উত্তরে বলেছিলেন, 'মনের সেই অবস্থা যখন সে পুকুরের টলটলে স্বচ্ছ পানি দেখতে পারে। পাহাড়ের উপর চড়ে গিয়ে পুকুরের তলার নুড়িপাথর, গাছপালা সে স্পষ্ট দেখতে পারে। পুকুরটা হলো বাস্তবতা।'"
নির্বাণ হলো বাস্তবতার ক্রমাগত পরিবর্তন, কেন ঘটনা ঘটে, কেন মানুষ ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যায় সেটা পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারা। এই কারণ বুঝতে পারার কারণে সেটা মেনে নিয়ে মন থেকে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। এই নির্বাণ হল মুক্তি। জীবনে দুঃখ-কষ্টের যে অসীম ও অবারিত চক্র তা থেকে মুক্তি পাবার উপায় এই নির্বাণ। এটি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয় বরং সবকিছুর সাথে নিজেকে এক করে যুক্ত করার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। আর এই নির্বাণ জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধে। এই স্তরে পৌঁছে গেলে আর নতুনভাবে জন্ম সম্ভব না। ফলে নতুন মৃত্যুও হয় না। হয় পরিনির্বাণ। সেই পরিনির্বাণের মাধ্যমে সে সংসারের চক্র, কার্মা থেকে মুক্তি লাভ করে। 
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই নির্বাণের অনুভূতি কেমন? বুদ্ধ বলেন, অদ্বৈত এই অবস্থার চারটি আকৃতিহীন জগত আছে। অসীম স্থান, অসীম চেতনা, শূন্যতা ও চৈতন্য-অচৈতন্যের ঊর্ধ্বে উঠে গেলে দেহ ও মন ছাড়া একটা অবস্থায় পৌছানো সম্ভব। এর মাধ্যমে সাংসারিক চক্রের থেকে পালানো সম্ভব। কিন্তু বুদ্ধ এরপরেই বলেন, এর কোনটাই নির্বাণ না। কারণ নির্বাণ ঠিক পালিয়ে যাওয়াও না। এই ধরণের হেঁয়ালির জন্য তাঁর শিক্ষা শুনতে সহজ মনে হলেও বেশ মজার আর তাই কঠিন।

শূন্যতা কী? বুদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি

নাগার্জুন। বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান বিভাগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ও লেখক হিসেবে তাঁকে মনে করা হয়। জন্ম দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্র প্রদেশে বলে ধারণা করা হয়*। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলঃ
शुन्पता करुणा गर्भम्

শূন্যতা কারুণা গার্ভাম

Emptiness is the Womb of Compassion

অর্থাৎ সহমর্মিতার দ্বারা বোধিসত্তা অর্জন করতে হলে আগে শূন্যতা অর্জন করতে হবে। এই শূন্যতার কথা গৌতম বলে গেছেন। কোন আলাদা অস্তিত্ব কারো নেই। সবাই একটি আদি ও অন্তহীন একটা অস্তিত্বের, একটি চক্রের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। কোন বিগ ব্যাং বা ক্রাঞ্চের অস্তিত্ব নেই। এটাকেই বৌদ্ধ দর্শনে বলা হচ্ছে, সংসার বা সামসারা। এই চক্র বা সংসারে আবদ্ধ হয়ে যায় মানুষ যখন এর প্রতি যুক্ত হতে চায়। পার্থিব বস্তুর সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলে দুঃখ পোহাতে হয়। যা তাঁকে আরো দুর্দশায় ফেলে দেয়। তাই এ থেকে মুক্ত হওয়া উচিৎ। মোক্ষ বা নির্বাণ পেলে এর থেকে মুক্তি। আর এর প্রথম ধাপ হলো এই শূন্যতার উপলব্ধি। একেকজন মানুষ বা যেকোনো অস্তিত্ব আলাদা কিছু না। সবকিছুকে ভাগ করলে যেমন একই প্রোটন- ইলেকট্রন পাওয়া যায়, তেমনি ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু আদতে তাঁর ক্ষুদ্রতম বিভাজনে গেলে একই জিনিস। এই কথাটা দিয়ে বুদ্ধ চেয়েছেন, সবাই যাতে বুঝতে পারে প্রতিটি জীব এক অপরের সাথে যুক্ত। কেউ আলাদা কোন মানে রাখে না। ফলে একেকটি মানুষ একটি শূন্য খোলস মাত্র।

প্রফেসর থারম্যান এটাকে ব্যাখ্যা করেন কার্তেসীয় ব্যবস্থা দিয়ে। একটা বিন্দু আসলে x-y অক্ষে বিন্দু নয়, বৃত্ত। তাই সেই বৃত্তের প্রকৃত অবস্থান খুঁজে বের করতে গেলে একদম সঠিক ভুজ ও কোটির মান বের করা সম্ভব না। সেটা করতে গেলে সেই বিন্দুর অস্তিত্ব আর থাকবে না। এই যে আসল জায়গাটা খুঁজে বের করতে গিয়ে সমস্ত অস্তিত্বটাই নাই হয়ে যাওয়া, এটাই বুদ্ধের শূন্যতা। 

কেউ যদি ধ্যান শুরু করে এই চিন্তা করে যে সে এই শূন্যতাকে খুঁজে বের করবে, তাহলে সে আসলে তাঁর অস্তিত্বকেই বের করবে। কিন্তু সে এতে সক্ষম হবে না। কেননা, বুদ্ধের মতে অস্তিত্বটাই নেই। মানুষের খোল বদলায়, বড় হয়, বয়স হয়। মনের গভীরে যে পরিচয়টা সে ধারণ করে, যে বিষয়টা আমাকে 'আমি' করে তুলে সেটা আসলে কিছু না। কিছু না থাকা থেকে এই শূন্যতা। 

এই যে না থাকার অনুভূতি ও নিরাসক্তি এই ধারণা কিন্তু বাউলধারাতেও মেলে। সত্যিকারের মৃত্যুর আগেই কেউ যদি সেই শূন্যতা অনুভন করে ফেলতে পারে, তবেই জন্ম সার্থক। যেমনটা বলে গেছেন, কবির তাঁর দোঁহাতেঃ

ত্যজো অভিমানা শিখো জ্ঞানা -- অভিমান ত্যাগ করে জ্ঞান শেখো

সত্গুরু সঙ্গত তরতা হৈ -- সৎগুরুর সঙ্গ নিলেই ত্রাণ

কহৈঁ কবীর কোই বিরল হিংসা -- কবীর বলেন, কোথায় সেই বিরল হংসসাধক

জীবতাহী জো মরতা হৈ। -- জীবনেই মৃত্যুলাভ করেছে যে

আবার বাংলার লালন ফকির গানে গানে বলেনঃ

মরার আগে মরে 

শমন-জ্বালা ঘুচে যায়।

জানগে সে মরা কেমন, 

মুরশীদ ধরে জানতে হয়।

আবার পারস্যের লোকপ্রিয় সূফী কবি জালালউদ্দিন রুমী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'মসনবী' তে তোতা কাহিনীতে বলেন,

"মরার আগেই যদি মরতে পারো, তবেই মোক্ষলাভ। মড়ার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, মান-অপমান বোধ নেই। সে তখন মুক্ত, সে নির্বাণ মোক্ষ সবই পেয়ে গিয়েছে। তাই মরার আগে মরবার চেষ্টা করো"

এরকম সব সাধকদের মাঝে একই কথা উচ্চারিত হলেই যে তা সত্য হয়ে যায় তা কিন্তু না, বরং বিষয়টা এই জিনিসটাই প্রমাণ করে যে, আলাদা আলাদাভাবে ভাবের সাধনা করে একটি সুন্দর মতবাদে অনেক পথ ধরে এসেই মিলিত হওয়া যায়। এখানেই এই দার্শনিক কথার সার্থকতা ও সৌন্দর্য। 

কার্মা (কর্ম) ও ধার্মা (ধর্ম) কী?

কার্মা বা কর্ম এর আক্ষরিক অর্থ হল কাজ। এই কাজ দ্বারাই একজন মানুষের মৃত্যুর পর জন্ম নির্ধারণ হয়। ভাল ভাল কাজ, পুণ্যের কাজ করে যেতে পারলে ধীরে ধীরে উচ্চতর জীবন লাভ হয়। আর অযাচিত, খারাপ কর্মের কারণে পুনর্জন্মে নিম্নতর জীবন লাভ হয়। এই কর্ম হল শরীর, বাক্য, চিন্তা দ্বারা করা কাজ। যদি সামগ্রিক মানবকল্যাণে মানুষ নিজের দেহ, কথা, মননশীলতা ব্যবহার না করে তবে তার কর্মের ঝুলি খালি হয়। মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ তার জন্য হয় সুদূরপরাহত। ঠিক উল্টোভাবে সঠিক কাজের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জন্মান্তরে অর্জিত কার্মা দ্বারা জীবনের এই চক্র থেকে মুক্তি সম্ভব। এই সঠিক কাজগুলো হল ধার্মা বা ধর্ম। যথোচিত কাজ। এই ধর্ম দ্বারা মূলত সর্বজনীন নিয়ম বা আদর্শ পথকে বুঝায়। এই নীতিগুলো সব কালের জন্য, সব মানুষের জন্য, সব অবস্থার জন্য সত্য। এই ধর্মের রীতি মেনে চললে কার্মার চক্র থেকে মুক্তি মেলে। আসে নির্বাণ। মোক্ষ। বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিরত্ন (সকল বৌদ্ধের তিনটি আশ্রয়স্থল) হলোঃ
১/ ধর্ম 
২/ বুদ্ধ
৩/ সংঘ 
অর্থাৎ বুদ্ধের বলা রীতি-নীতি মেনে চলে সংঘের আশ্রয়ে এসে নির্বাণ লাভ করাই প্রকৃত মুক্তি ও উদ্দেশ্য।

অষ্টমার্গ


আটটি পথের যে উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো তিনটি মহাশিক্ষার অন্তর্গত। প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি। জ্ঞান, নৈতিকতা ও ধ্যান। Wisdom, Virtue and Meditation.

মহাশিক্ষা - ১। প্রজ্ঞা (Wisdom)
১। সম্যক দৃষ্টি (Right theory)
২। সম্যক সংকল্প (Right intention)

মহাশিক্ষা - ২। নৈতিকতা (Moral Virtues)
৩। সম্যক বচন (Right speech)
৪। সম্যক কর্ম (Right action)
৫। সম্যক জীবিকা (Right livelihood)

মহাশিক্ষা - ৩। ধ্যান বা সমাধি (Meditation)
৬। সম্যক ব্যায়াম (Right effort)
৭। সম্যক স্মৃতি (Right mindfulness)
৮। সম্যক সমাধি (Right concentration)

প্রজ্ঞাঃ


সবকিছুই আপেক্ষিক। জগতে পরম সত্য বলে কিছু নেই। আত্মার পরম অস্তিত্ব নেই। আমাদের সত্ত্বাসহ সবকিছুতে একটা খালিপনা (Emptiness) আছে। একটা শূন্যতা। কিন্তু তাই বলে এটা নিহিলিস্টদের মতো 'নাই'তত্ত্ব (Nothingness) নয়। আর এই শূন্যতা এমন এক অস্তিত্বের কথা বলে যা না থাকার কারণে মানুষ একাত্মতা বোধ করতে পারে। এই শূন্যতা আত্মাকে অস্বীকার করলেও একটা শক্তির মতো। যা এক দেহ বা জন্ম হতে অন্য দেহ বা জন্মে স্থানান্তরিত হয়। হ্যাঁ, বৌদ্ধমতে পুনর্জন্ম বিদ্যমান। 
এখন আধুনিক বিজ্ঞানের মতে যেমন শক্তির শুরু বা শেষ নেই তেমনি সাধারণত মৃত্যুর পর এই মানুষের মনন বা তার অর্জিত কর্ম (কার্মা - karma) শক্তির মত আরেক দেহে বা জন্মে স্থানান্তরিত হয়। এই কার্মার বিষয়টাই শুদ্ধ করতে গৌতম শিক্ষা দিয়ে গেছেন। উচিৎ কর্ম, সুষ্ঠু কর্ম করে গেলে উন্নত জীবন পাওয়া যায়, ঠিক। কিন্তু মানুষের প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নির্বাণ লাভ। এই কার্মার চক্র হতে মুক্তিলাভ। মোক্ষের অর্জন। যখন মানুষ তার উত্তম কর্মের দ্বারা, উচিৎ বাক্য, ব্যবহার, জীবন, চিন্তা - দ্বারা ধ্যানের মাধ্যমে উৎকৃষ্টতা অর্জন করে তখন সে লাভ করে নির্বাণ।
এই নির্বাণটাও আবার পরম সত্য নয়। থেরোবাদ মতবাদের প্রথমে সেটা ভাবতে দেয়া হয় কিন্তু পরবর্তীতে সংঘজীবনে এসে এই ভুল ভাঙ্গানো হয়*। আর মহাযান ও বজ্রযানে প্রথমেই নির্বাণলাভের পরমতা নাকচ করে দেয়া হয়। 
বুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল, কেউ সবকিছু থেকে আলাদা থেকে, সবকিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে শান্তি লাভ করতে পারবে না। অজ্ঞানতা সুখ নয়। বরং বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করার মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ লাভ সম্ভব। আবার কোনকিছুই চরম নয়, আপেক্ষিক। সে হোক সম্পর্ক, সে হোক অস্তিত্ব, সে হোক শিক্ষা, সে হোক জীবনযাত্রা, সে হোক উপলব্ধি।

আবার এই আপেক্ষিতার মাধ্যমে গৌতম বুদ্ধ তখন প্রচলিত বৈদিক ধর্মের শিক্ষার বিপক্ষ পক্ষে অবস্থান করেছিলেন। তাই বলে তিনি পুরোপুরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি। তাঁর মতে, স্রষ্টা সৃষ্টি করার পর সৃষ্ট সবকিছু হতে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। তিনি হয় সৃষ্টির সাথে মিশে থাকেন, বা অন্য কোন স্থানে সৃষ্টির মত অবস্থান নিয়ে থাকেন। স্রষ্টার পরম অবস্থান বলে কিছুর অস্তিত্ব বুদ্ধ অস্বীকার করেন। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে তিনি তৎকালীন ভারতীয় নিরীশ্বরবাদ চিন্তাধারার বাহক ছিলেন। প্রচারক ছিলেন না।
একইসাথে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার বাণীও প্রচার করেছেন। তার সংঘে কোন বর্ণবাদের অস্তিত্ব ছিল না। প্রথমে নারীর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তিনি চিন্তিত থাকলেও পরবর্তীতে বেশ কয়েকজনের অনুরোধ-উপরোধে তিনি তা মেনে নেন।এ ব্যাপারে সুপারিশকারীদের মাঝে আছে, তাঁর মা মহাপ্রজাপতি, স্ত্রী যশোধরা ও সার্বক্ষনিক সঙ্গী আনন্দ। তাছাড়া বৈশালীর নগরবণিতা আম্রপালী তো এমনিতেই ভুবনখ্যাত। 
এইভাবে সর্বব্যাপী ধারণা ও অভিপ্রায় নিয়ে মনন গঠন করতে পারলে আত্মিক শান্তি পাওয়া সহজ হয়। তাঁর দর্শনে তাই জানাটা জরুরি আগে। জানতে হবে। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে হবে। অন্যে পথ দেখিয়ে দিতে পারে। হাঁটতে হয় নিজেরই। 
তাই বুদ্ধের দর্শনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো - সবকিছুকে প্রশ্ন করা। সবকিছু। এমনকি বুদ্ধের কথাকেও। নিজে উপলব্ধি না করলে, নিজেকে দিয়ে না বোধগম্য হলে কোন জ্ঞানই পরিপূর্ণ হয় না। অভিজ্ঞতার দাম সবচেয়ে বেশি। সেইজন্য কোন কথাই আপ্তবাক্য হিসেবে নেয়া ঠিক না। শুনে-দেখে শেখা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। নিশ্চয়ই। কিন্তু সে থেকে চরম শিক্ষা হয় না। তার জন্য দরকার ঠেকে শেখা। এই খোলামনের পরিচয় গৌতমের শিক্ষার এক উজ্জ্বল দিক। তাই জ্ঞানের দিকটা ঠিক করে ঠিক ইচ্ছা নিয়ে আগানো হলে নৈতিকতার শিক্ষা সহজ হয়ে যায়।

বুদ্ধের দর্শনে তাই সঠিক জ্ঞানার্জন তথা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃতার্থে এটাই প্রথম ধাপ।

নৈতিকতাঃ


সঠিক জ্ঞান ও সম্যক বিবেচনা গঠনের পরের ধাপ হল নৈতিকভাবে উন্নত মননের অধিকারী হওয়া। আর নৈতিকতার চর্চা নিয়ে বলতে গিয়ে সিদ্ধার্থ কুশল শব্দটার ব্যবহার করেছেন। কুশলঃ কল্যাণযুক্ত, দক্ষ। মানে এসব নৈতিক চর্চায় কুশলী হতে হবে। শুধু জেনে গেলাম আর মাঝে মাঝে করে গেলাম-তা না মোটেও। সজ্ঞানে জোর করে এসব গুণাগুণের অভ্যাস তৈরি করলে ধীরে ধীরে চরিত্রের উন্নতি হবে। এই কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে - শেষ পর্যন্ত যাতে নিজে থেকে ভালো কাজের উদ্যোগ না নিতে হয়। আপনা থেকেই মন-মানসিকতায় উত্তম স্বভাব গড়ে উঠে। 
নৈতিকতার শিক্ষাকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

মাধ্যম

অকুশলী উপায়

কুশলী উপায়

দেহ

জীবন নেয়া

জীবন বাঁচানো

চুরি করা

উপহার দেয়া

কামের অমার্জিত ব্যবহার

কামের সুব্যবহার

বাক্য

মিথ্যা বলা

সত্য বলা

বিভেদের কথা বলা

সম্মিলনের কথা বলা

কঠোর কথা বলা

নরম সুরে কথা বলা

অর্থহীন কথা বলা

প্রকৃত অর্থপূর্ণ কথা বলা

মন

লোভ করা

উদার হওয়া

হিংসা করা

কামনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা

অন্যের সম্পদের লালসা

সন্তুষ্টি

ঘৃণা বা ক্ষতি করার মনোভাব

প্রশংসা করা

অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি

বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও খোলা মন


জীবনের কদর না করা। জীবহত্যা করা। এসব কাজে মত্ত থাকা মানুষের জীবনীশক্তির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আরেকটি জীবন কেড়ে নেয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া। কেননা বুদ্ধ বলেন, প্রতিটি জীব, প্রতিটি অস্তিত্ব এক অপরের সাথে যুক্ত। তাই স্বেচ্ছায় একটির ক্ষতি করা প্রকারান্তরে নিজের ও পুরো জগতের ক্ষতি করার সমতুল্য। তাই এর থেকে ভাল বরঞ্চ জীবন বাঁচানো। সুযোগ থাকলে সেই ব্যবস্থা করা যাতে জীবের জীবন বেঁচে যায়। শাকাহারী হওয়া, মানুষহত্যা না করা, শিকার না করা। 
আবার যে জিনিস কারো নিজের নয়, তা আত্মসাৎ করা। চুরি করা, জোরদখল করা - এসব অযাচিত কাজ। এতে অন্যের ক্ষতি করা হয়। বরং মানুষকে উপহার দেয়া উত্তম কাজ। তাছাড়া কামের বশবর্তী হয়ে অনুচিত কাজ করা মনুষ্যত্বের অপচয়। সেই জায়গায় ভালোবাসা, অনুকম্পা, সহানুভূতি নিয়ে কামে জড়িত হওয়া বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে জরুরি। 

বুদ্ধের এই শিক্ষাগুলোর মাঝে এক বিশ্ববাদের ডাক আছে। আছে কোমল এক শান্তির ছোঁয়া। সবকিছুকে ও সবাইকে আপন করে দেখার মাঝে সুখের অবস্থান-এই আপ্তবাক্য তিনি দিয়ে গেছেন।

বাক্য ব্যয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কথার মাধ্যমে আমরা মানুষের সাথে যুক্ত হই। মানুষের সাথে বন্ধন তৈরির জন্য জন্ম ছাড়া আর একটি প্রধান উপায় হল কথা বলা। আর তাই এই বিষয়ে সংযত ও উদার হওয়া আবশ্যক। মিথ্যা বললে অন্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিজের উপকারের জন্য এভাবে অন্যের ক্ষতির কারণ হওয়া জীবনের জন্য হানিকর। তাই সত্যের অভ্যাস জরুরি। সত্য যেমন সুন্দর, তেমনি সত্য মানুষকে কাছাকাছি আনতে পারে সহজে। কেবল শর্ত এই যে, সত্য সমাজে সব স্তরে সমানভাবে সমাদৃত।
আমাদের কথা বলার সময় খেয়াল রাখা উচিৎ যাতে আমাদের বাক্যে কোন বিভেদের সুর না বাজে। কাউকে আলাদা করে কথা বলা, অন্য কাউকে দূরে সরিয়ে দেয়া বা কোন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কাছে টেনে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়া, মানুষের মাঝে ঘৃণা তৈরি করার জন্য কথা বলা - এসব থেকে বিরত থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ। 
মানুষের মাঝে প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলা, সকল মানবতার জন্য এক সুর গাঁথার মাধ্যমে বিশ্বমাতৃকার আদর্শ মানুষ হবার মন্ত্রই হল বুদ্ধের মন্ত্র।
বক্তার কথায় কড়া সুর যে শুনছে তার জন্য কষ্টদায়ক। অপরকে কষ্ট দেয়া জাগতিক উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। তাই যে ব্যক্তি জীবন ধারণে সত্যিকারের কুশলী বা দক্ষ সে নরম সুর ব্যবহার করবে। মানুষকে দূরে না ঠেলে কাছে টানবে। 
এবং বক্তার আরেকটি দায়িত্ব হল শ্রোতার মনোযোগকে কলুষিত না করা। একজন শ্রোতা যখন কারো কথা শুনতে থাকে তখন সে তার মনোযোগ বা মননের দরজা তার দিকে খুলে দেয়। সে তার চিন্তা-ভাবনাকে একটু সময়ের জন্য পাশে রেখে তার কথা শোনার জন্য সেদিকে ধ্যান দেয়। তাই সেইসময় বক্তা যদি নিরর্থক, অহেতুক, কুরুচিপূর্ণ কথা বলে তা নামান্তরে কথার অপচয়। মনোযোগের অপচয়। এই অবিবেচনার কাজ না করে মানুষের উচিৎ সুচিন্তিত কাজ করা। সঠিকরূপে শিক্ষিত হয়ে সেই শিক্ষার আলোকে জীবন গঠন করে তা অপরের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। 

মনের যথার্থাস্য (যথার্থ দিকে স্থাপনা; যথার্থ+অস্য) নৈতিকতা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। লোভ-হিংসা পোষণ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বৃহত্তর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। হিংসা-লোভ লালন করার মানে হল নিজের যা আছে তাতে অসন্তুষ্টি। অন্যের সাথে নিজের তুলনা করলে নিজের মধ্যে অশান্তি তৈরি হয়। এই অশান্তি থেকে ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা আসতেই পারে। যা মোটেও কাম্য নয়। কারণ মানুষ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সে একা দ্বীপে বাস করে না। তাই তার উচিৎ উদার মানসিকতা ধারণ করা। সকলের সাথে সম্মিলনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা। সন্তুষ্টির চর্চা করা। ঘৃণার লালন না করে মানুষের প্রকৃত মূল্য বুঝার মাধ্যমে তার প্রশংসা করা। তার অস্তিত্বের গুণ গাওয়া। তবেই না তৈরি হবে শান্তি-সমৃদ্ধির সমাজ ও বিশ্ব। আর সর্বশেষ শিক্ষা হল বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মন-মানসিকতা তৈরি করা। অবাস্তবতায় অর্থাৎ নশ্বর কোন কিছুর পেছনে সময়-বিদ্যা নষ্ট না করে পরম মোক্ষ লাভের জন্য যে জীবনবোধ প্রয়োজন তার ধারণ ও চর্চা করাই মানুষের প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।

আর এসকল চিন্তা ও কাজ ধারণ করতে পারলে বুদ্ধের মতে নৈতিক শিক্ষা হয়ে যাবে। অনেক আয়েশে এটা বলে দেয়া গেলেও প্রকৃত অর্থে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ কতটা কঠিন তা আজকের বিশ্বের দিকে তাকালে সহজেই বুঝা যায়। 

সমাধি বা ধ্যানঃ

অনেকের কাছে বৌদ্ধ মতাবলম্বী মানেই ধ্যানে বসে থাকা, কঠোর তপস্যা করা, সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। ধ্যান অনেক পরের বিষয়। তার আগে জ্ঞান ও সঠিক মননের গঠন জরুরি। আমরা সবাই ধ্যানে মত্ত থাকি। 
ধ্যান মূলত কী? একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তীব্র মনোযোগ দেয়া যাতে সেই বিষয়টি আমাদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। যাতে আমাদের চিন্তাধারায় একটি গভীর ছাপ রেখে যায়।
সেই অর্থে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই ধ্যানে ডুবে যাই। মোবাইল, কম্পিউটার, টিভির পর্দায় বা আড্ডার আসরে বা কর্মক্ষেত্রে। এই ধ্যানের দরকার আছে। কিন্তু বাস্তবিক পথে। 
আবার সম্প্রতি কর্মময়-ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনেকে মেডিটেশন বা ধ্যানের আশ্রয় নেয়। কিন্তু এই ধ্যানে প্রকৃত লাভ সম্ভব না। কারণ এটা অল্প কিছু সময়ের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা, আমাদের দুঃখ, আমাদের হতাশা থেকে দূরে রাখে। আসল মুক্তি আনতে পারে না। আবার সঠিক মনোনিবেশ না থাকলে শান্তি তো দূরে থাক, অশান্তি আরো বেড়ে যায়। তাই প্রকৃত মুক্তির পথ হল - আগে জানা, পরে সেই মোতাবেক নীতিগত আচরণের শুদ্ধি সাধন করা এবং সবশেষে ধ্যানে নিমজ্জিত হওয়া যাতে করে এসব শিক্ষা পুরোপুরিভাবে মননে গেঁথে যায়। জীবন যাপন যাতে সহজ হয়ে যায়। নির্মোহ-নির্লোভ জীবনের জন্য এই চর্চার বিকল্প নেই।
মানুষ ক্রমাগত নানা ভোগ-বিলাসের তাড়নায়, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে দুঃখ-দুর্দশায় পড়ে। এর কোন শেষ নেই। তাই এর চক্করে পড়ে সবসময় চিন্তিত-ব্যথিত থাকার মানে নেই। একে গ্রহণ করতে হবে। মানুষের অস্তিত্বের এটি একটি আবশ্যিক বিষয়। এর থেকে কারোরই নিস্তার নেই। ফলে এ নিয়ে পড়ে থাকা অপচয়। এটাই বাস্তবতা। একে মেনে নিতে পারাই সাফল্য। 
আর এই জিনিসটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে সন্ন্যাস জীবন দরকারি। কেননা এই ব্রত পালন করার মাধ্যমে মানুষ পার্থিব অনেক ভোগ-বিলাস থেকে মুক্ত থাকতে পারে যা তাকে প্রকৃত সাধনাতে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। তাই দরকার চিন্তাশীল উদ্যোগ, সঠিক মাত্রার ও সঠিক দিকের মনোযোগ। নিজের চিন্তার দ্বারা নিজের চিন্তার ধারা বদলে দেয়া। 
এই সকল শিক্ষা মূলত সংস্কৃত শব্দ অভিগমধর্ম দিয়ে প্রকাশ করা হয়। মানে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা মূলত অষ্টমার্গের সকল অধিশিক্ষার (জ্ঞান, নৈতিকতা, সমাধি) চালিকাশক্তি। ইংরেজিতে এই বিষয়টাকে আন্ডারস্ট্যান্ড বলা হয়। কারো থেকে আদেশ গ্রহণ করে সেটা বুঝতে পারার একটা ব্যাপার আছে এখানে। কিন্তু সংস্কৃতে এই ধারণাটা অনেক বেশি উদার। নিজের এক নতুন সংস্করণ তৈরি করার নামই শিক্ষা বা বোধগম্য হওয়া।
এই ধারণাটার পুরো বিপরীত হলো অলসতা, অনীহা, উদাসীনতা। আর এই বিষয়টাই মানুষের প্রকৃত মুক্তির পথে বাধা। সে যদি সুচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কার্যকরভাবে সেই মুক্তির পথ খুঁজে যায় তবে সে তা পাবে। বুদ্ধের উপদেশ সেইজন্যই আছে। পাশাপাশি তাকে নিজের চিন্তার উপর নির্ভর করতে হবে। নিজের উপলব্ধির উপর আর কিছু নেই সেটা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। 
বুদ্ধের উপদেশের আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে কিছুকেই একদম চরমসত্য মনে না করা। ফলে নিজের চিন্তাকেও বিশ্বাস করার প্রশ্ন আসে না। এ এক অদ্ভুত রকম হেঁয়ালি। আর এর জন্যই জীবন সুন্দর। এতো হেঁয়ালি, এতো দ্ব্যর্থতা, এতো উপহাস, এতো দুর্দশা থাকার পরও মানুষের বাঁচার ইচ্ছাটা সুন্দর। 
সাত নম্বর মার্গটি হলো স্মৃতি। মনে রাখা। আমি কোথায় আছি। আমি কি করছি। এসবের সূক্ষ্ম চিন্তা ভাবনা। নিজের সম্পর্কে আরো ওয়াকিবহাল হওয়া। মূল কথা হলো, নিজেকে জানা। নিজের অবচেতন মনকে সামনে আনা। তাকে চেতনার অংশ করে নেয়া। আমাদের মনের ভিতরকার যে প্রচ্ছন্ন আবেগ, যে অপ্রকট প্রতিক্রিয়া সেসব সম্পর্কে জানার জন্য এটি জরুরি। সহজাত প্রবৃত্তির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা।
মনের  মাধ্যমে এটা করা সম্ভব আর কেবল এটিই বড় বড় কর্পোরেট জগতে বিখ্যাত হয়ে উঠছে। আগেও বলেছি, কেবল একটি মার্গের লেজ ধরে থেকে লাভ হয় না। এটি একটার পর একটা অর্জন করতে হয়। ফলে, ধনী কর্পোরেট শ্রমিকদের সাময়িক শান্তি দিতে পারে এই ধ্যান। রক্তচাপ কমিয়ে সুন্দর দেহ, কিছুদিনের জন্য নির্মল মন দিতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাগতিক চক্রের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি দেয় না। ফলে মানুষের দুঃখ-কষ্টেরও শেষ হয় না। 'আরো চাই, আরো চাই' এর ফাঁদে পড়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেয়েও তৃপ্তি হয় না।
মনের প্রশিক্ষণের জন্য শেষ এই দুইটি মার্গের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে সঠিক নৈতিক শিক্ষা আয়ত্ত করলে পরেই মন-সংযোগ করা যায় বৃহত্তর কাজে। যা হল এই ধ্যান। মনের শক্তির চেয়ে বড় কিছু নাই। মনকে সওয়াতে পারলে যেকোন আবেগের লাগাম ধরে রাখা যায়। সে তীব্র কষ্টের ব্যথা হোক, কি প্রচণ্ড সুখের অপরিমেয় উচ্ছ্বাস। 

অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে আলোকিত মানুষ হতে গেলে ও এই বুদ্ধত্বের মানে বুঝতে হলে এই সূত্রটি বুঝতে হবে।
ENLIGHTENED = REALISTIC + DECENT + IN CONTROL OF YOURSELF
প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া মানে হল, বাস্তবতা সম্পর্কে জানা, শালীন ও নৈতিক হওয়া এবং নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এই কথাটা বারবার বলা হয়েছে। তাই আমিও বারবারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই বলছি। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।


এই তিনটি অধিশিক্ষা রপ্ত হয়ে গেলে মানুষ মুক্তির আনন্দ পেতে সক্ষম হবে বলে বুদ্ধ শিখিয়ে গিয়েছেন। জানা, উপলব্ধি করা, মনোযোগ দিয়ে জীবনে প্রতিফলিত করা। সহজ তিনটি ধাপ। কিন্তু সাংসারিক আবর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলে এই শিক্ষার অর্জন ও প্রয়োগ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। শুদ্ধ মনের চর্চা শুনতে সহজ লাগলেও প্রকৃতার্থে বাস্তবায়ন করার মতো লোক কিছুটা কমই বৈকি! গৌতম বুদ্ধ নিজেও তা জানতেন। আর সেই কারণেই এর প্রচারে তাঁর অনীহা ছিল প্রথমে।


সহমর্মিতাঃ বুদ্ধত্ব অর্জনের পূর্বশর্ত

সহমর্মিতা বা অন্য জীবের সাথে একাত্মতা বোধ করার জন্য অসঙ্গের (চতুর্থ শতাব্দী) সাতটি পথের আলোচনা করা যায়। 

১। সকল জীবের মাঝে মাতৃত্ব খুঁজে নেয়াঃ- আমাদের জীবন অসীম সময় ধরে চলে আসছে ও অসীম সময় ধরে চলবে। আর এর মাঝেই প্রতিটি জীব বারবার জন্ম নিতে থাকবে সংসারের এক অমোঘ চক্রে। একেকবার একেকরূপে। ফলে যেকোন জীব বা মানুষ কোন এক জন্মে আমাদের জননী ছিল। বর্তমান জীবনে সে প্রাণের শত্রু বা সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও তাঁর মাঝেও যে এক মাতৃত্ব আছে তা মেনে নিলে এই ধাপ অতিক্রম করা হয়। কেননা পরোপকারিতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত হল মা।
২। মাতৃত্বের মমতার কথা মনে করাঃ- যে এখন আমার শত্রু সেও একসময় পরমযত্নে আমাদের লালন পালন করেছে মারূপে। যাবতীয় প্রয়োজন থেকে শুরু করে অন্যায় আবদার-সব মিটিয়ে দিয়েছে এতটুকু বিরক্ত না হয়ে। এই চিন্তার দ্বারা মনে এক অভাবনীয় উষ্ণতা চলে আসে। এবং এটা কেবল মানুষের জন্য না, বরং সকল জীবজগতের জন্যই সত্য।
৩। কৃতজ্ঞতা অনুভব করাঃ- মাতৃত্বের এই দানের স্মরণ রেখে মনে মনে কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি করা। বোধ থেকে এই দানের প্রতিদান দেবার জন্য সচেষ্ট হওয়া। 
৪। প্রেমানুভব করাঃ- সকল জীব ও সকল ধরণের মানুষের প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের অনুভূতি পাওয়ার মাধ্যমে প্রেমভাব তৈরি করা। সকল জীবের মঙ্গল কামনা করা।
৫। সকলের কষ্ট-ক্লেশ সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও সমব্যথী হওয়াঃ- সবাই যে সংসারের কার্মিক চক্রের অংশ সেটা বুঝতে পেরে সবার যে দুঃখ-দুর্দশা সইতে হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারা। আর এটা বুঝতে পারার কারণে সকলের সাথে সমব্যথী হওয়া।
৬। সামগ্রিক দায়িত্বঃ- সবার ব্যথার অনুভবের সম্পর্কে জানার পর তাকে দূর করার জন্য নিজের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করা। অন্যকে বেদনা থেকে মুক্ত করে সামগ্রিক সুখ-সাচ্ছন্দ্যের দিকে কীভাবে নেয়া যায় সেই চেষ্টায় ব্রতী হওয়া এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার অংশ।
৭। বোধিচিত্তঃ- সবাইকে সাহায্য করার জন্য নিজের আসন্ন সকল জন্মে ব্রতী হওয়াই বোধিচিত্ত বা সহমর্মিতা অর্জনের শেষ তান্ত্রিক ধাপ। 
এখন, এই সাতটি ধাপে ধ্যান পরিচালনা করার মাধ্যমে বোধিচিত্ত অর্জন করা যায়। এগুলো হল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার চিন্তা। তাই এর চর্চার আগে চিন্তাধারার শুদ্ধি প্রয়োজন। শ্রীজ্ঞান অতীশ বলে গেছেনঃ
এই তিনটি শর্ত মেনে নিলে সহমর্মিতার ধ্যান সফল হবে-
১। অসীম পরিমাণ অতীতের ও ভবিষ্যৎ যে আছে, সেটা সাধারণভাবে ধারণায় লালন করা
২। সাহায্য করার মানসিকতা তৈরি করা
৩। একজন বোধিচিত্তের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া যে এরইমধ্যে সহমর্মী সত্তার অধিকারী হয়েছে।

আবার শান্তিদেব (অষ্টম শতাব্দীর নালন্দা ড্রপআউট) এই সমব্যথিতা অর্জনের জন্য বলেছেন নিজের ভেতরকার রাগকে জয় করতে। ধৈর্যের লালন করার মাধ্যমে অপরের ক্ষতি করার মানসিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া। ক্ষমা করে দেয়ার ধৈর্য নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলে এই সহমর্মিতা অর্জন সবচেয়ে সহজ হয়ে যাবে। কাউকে পথ দেখানোর সময়ে আঙ্গুল দিয়ে দিক না দেখিয়ে সমস্ত হাতের ব্যবহার উন্নত মানসিকতার পরিচায়ক কেননা এর দ্বারা আমাদের ভেতরকার উদারতা প্রকাশ পায়। এরকম ছোট ছোট দেহভঙ্গিতেও আত্মোন্নয়ন প্রকাশ পায় বলে শান্তিদেব বলেছেন। তাঁর বিখ্যাত বই Engaging in the Deeds of a Bodhisattva এ তিনি ধ্যানের জন্য আগে সমবেদনাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, 

"যদি যার যার দুঃখ তার তারই সামলাতে হতো
তবে পায়ে ব্যথা পেলে হাত এগিয়ে যায় কেনো?"

দালাই লামা (১৪তম) বলেন, 

"যদি সুখী হতে চাও, অন্যের দুঃখে সহমর্মী হও"

"স্বার্থপর যদি হতেই চাও, তবে জ্ঞানীর মতো হও। সমবেদনা তৈরি করো। কারণ সমব্যথী হওয়ার জন্য যে শান্তির অনুভূতি আসে সেটা নিজেরই হয়। অন্যের না।"

 মজার ব্যাপার হলো, মহাযানী রীতিমতে এই শান্তিদেবকে নালন্দাতে ভুসুকু বলা হত। ভুক্তি, সুপ্তি, কুটির। অর্থাৎ কুটিরে থেকে থেকে কেবল খাওয়া আর ঘুম ছাড়া সে কিছু করতো না। কিন্তু তিনি আদতে এ বিশাল বইখানা এই সময়ে লিখেন। আবার, বাংলার আদিতম নিদর্শন চর্যাপদে এক বাঙালি কবির সন্ধান পাওয়া যায়। যার নাম ভুসুকুপা। পদ রচনা করত দেখে নামের শেষে পা। দুইজন একই কিনা এ নিয়ে ভালো মতবিরোধ আছে।

"আপনা মাংসে হরিণা বৈরি" নামে যে প্রবাদ আছে বাংলায় যে হরিণের মাংসই হরিণের শত্রু - এটি তাঁরই লিখা। আবার তাঁর বাঙ্গালিয়ানার পরিচয় যেই পদ থেকে মেলে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এবং সন্দেহ যুক্তিযুক্ত। মল্লরী রাগে গেয় ৪৯ নং চর্যায় বলে,

ণাব পাড়ী পউআঁ খালে বাহিউ।।

অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ

আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।

ণিঅ ঘরিণী চন্ডালে লেলী

আধুনিক বাংলাঃ 

বজ্রনৌকা বেয়ে পাড়ি দেই পদ্মা খাল,
দেশ লুট ক’রে নিল অদয় বঙ্গাল।
ভুসুকু, বাঙালি হলি আজ থেকে ওরে,
নিজের ঘরনি গেল চাঁড়ালের ঘরে।

বাঙালি তো নয়ই বরং বাঙ্গালিয়ানাকে যেন খানিকটা বিদ্রূপই করছেন পদকার। সে যুগে সারকাজমের চর্চা বা নিজের বেহাল দশা নিয়ে চুটকি করার অভ্যাস থেকে থাকলে - সেই অর্থ বিবেচনায় ভুসুকুপা বাঙালি বটে।

বৌদ্ধ মতবাদের রাজনীতিঃ

গৌতমের সময়ে তিনি দর্শনে যেমন নতুন মোড়ের সন্ধান দেন ঠিক তেমনি রাজনীতিতে নিয়ে আসেন নতুন চিন্তাধারা। তিনি সেই অর্থে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেন নি, করতে চানও নি। তাঁর ভাবনায় সর্বলোকের মঙ্গলের জন্য উদার দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা ছিল। তিনি গণতান্ত্রিক এবং জাত-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ নিরপেক্ষ ছিলেন। সেই সময়ের মোতাবেক এটা ক্রান্তিকারী ছিল। তিনি নিজে রাজ্যপরিচালনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজনীতির জ্ঞান লোপ পায়নি। তিনি সকলকে তাঁর সংঘে গ্রহণ করতেন বলে অনেক পীড়াগ্রস্ত মানুষ যেমন আসতো, তেমনি আসতো উচ্চবর্ণীয় লোকেরা। সত্যের খোঁজে। মুক্তির খোঁজে। তাঁর প্রচারিত শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়েছেন রাজপুরুষ, নারী থেকে পথজীবি-সকলেই। তাঁর এই সর্বব্যাপী আবেদন সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছিল তাঁকে। মগধের (যেই জনপদের এক রাজ্যের যুবরাজ ছিলেন তিনি) রাজা বিম্বিসার ও পরবর্তীতে তাঁর ছেলে অজাতশত্রুর সাথে তিনি একান্ত সম্পর্ক রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
বৌদ্ধ সংঘের একটি অসম্ভব সুন্দর ও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য ছিল যে তাঁরা দিনে একবার খেতো। এবং সেটা মুষ্টিভিক্ষার মাধ্যমে। কোন লোকালয়ের আশেপাশে তাঁরা থাকতো। এবং সকালবেলা বের হয়ে যেত ভিক্ষার থলি নিয়ে। দুপুরের আগে মঠে পৌঁছে আহার সেরে নিতো। ব্যস! এই তাঁদের সারাদিনের আহার ও খাবারের পেছনে ঝক্কি। তাছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা আসতো নানান ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শাসকদের থেকে। তাঁর সংঘের আকার এতো বড় ছিল যে কোন ক্ষমতাবান শাসকই গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগাতে চায় নি। উল্টো সামলে রাখার জন্য ভাল সম্পর্ক রাখতেন। শ'য়ে শ'য়ে যুদ্ধে যাবার উপযোগী পুরুষ, ঘর সামলানোর নারী সন্ন্যাসব্রত নিয়ে সমাজের বারটা বাজিয়ে দিচ্ছে। তারপরও।
এই ব্যাপারটাই বৌদ্ধ মতবাদের সবচেয়ে অসুবিধাজনক দিক। রাজ্য তৈরি করে সেটা ধরে রাখা অসম্ভব। কারণ সকল কর্মক্ষম ও উপযুক্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাগতিক কর্মকাণ্ড ছেড়ে এহেন ভাবালুতার জগতে বিরাজমান হয়ে জ্ঞানের চর্চা করে গেলে পৃথিবী চালানো মুশকিল হয়ে যাবে। এটা সাধারণভাবেই বোধগম্য। এই গোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ কোন হুমকি নয় মোটেও। তাঁরা শান্তিকামী, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনে বিশ্বাসী। ফলে তাঁরা কখনো নিজ রাজ্যের ক্ষমতা দখলে তৎপর হবে না। ঝামেলাটা হলো বহিঃশক্তির থেকে। এতোগুলো যুদ্ধক্ষম মানুষ অহিংসাব্রত নিয়ে বসে থাকলে আর যাই হোক, কোন আদর্শ দিয়েই আর যুদ্ধ হয় না। এরই মাশুল দিতে হয়েছিল শাক্য রাজ্যকে। কোশল রাজ্য শাক্য দখল করে নেয় গৌতমের জীবদ্দশাতেই। জনবলহীন শাক্য সেনাবাহিনী বাইরে থেকে আসা হুমকি সামলাতে পারে নি। 
তবে বৌদ্ধ মতবাদে রাজনীতির সর্বাপেক্ষা ভালো উদাহরণ হলো সম্রাট অশোক। তাঁর দীর্ঘ ৩৬ বছরের (৩৬৮-৩৩২ বিসিই) রাজত্বে তিনি বৌদ্ধবাদ প্রচারের জন্য যা করেছেন, তা না হলে হয়তো এই দর্শন এতো ব্যাপকাকারে ধর্মের রূপ নিতো না। তাঁর বিখ্যাত দাদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের খ্যাতিও তিনি ছাড়িয়ে যান। 

অশোকের বৌদ্ধ মতবাদ গ্রহণ ও ধর্ম প্রচারঃ

মৌর্য সাম্রাজ্য শুরুতে মূলত গঙ্গার দুই পারেই বিস্তৃত ছিল নন্দের পতনের পরপর। চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসার (অশোকের পিতা) এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। কলিঙ্গ রাজ্য (বর্তমান অন্ধ্র, ওড়িশা ও বাংলার অংশ) দখল করতে চন্দ্রগুপ্ত চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। অশোক সেই কাজে ব্রতী হন সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই। উল্লেখ্য, সে সময়ে এই কলিঙ্গ ও চোলা-পান্ড্য রাজবংশের তামিলাকাম রাজ্য বাদে পুরো ভারতবর্ষ মৌর্য প্রভাববলয়ে ছিল। অশোক কলিঙ্গ জয় করতে ব্রতী হন এবং ২৬২ বিসিইতে তাঁর চেষ্টা সফল হন। কিন্তু এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দেখে অশোক ব্যথিত হন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ হতে শান্তির পথে আসার জন্য বৌদ্ধ মত গ্রহণ করেন। তিনি সত্যের আন্দোলন শুরু করেন এই দর্শন দিয়ে।
অশোক সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পাথরের উপর খোদাই করে আদেশনামা স্থাপন করেন। সেগুলোর একটির মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধে এক লাখ মানুষ ও জীব-জন্তু মারা যায় ও দেড় লাখের বেশি যুদ্ধবন্দী হয়। এই হানাহানির ব্যাপকতা দেখে অশোক অনুতপ্ত হন এবং বুদ্ধের দেখানো পথে-ধর্মকে-জীবন চালনার মন্ত্র করে নেন।
তিনি এরপর দিকে দিকে ছড়িয়ে দিলেন সংঘের সন্ন্যাসীদের ও অমাত্যদের। ৯টি মিশন পাঠানোর কথা পাওয়া যায়। এছাড়াও তিনি আদি ১০টি প্যাগোডার থেকে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে ৮৪,০০০ ভাগে ভাগ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পাথরের গায়ে, স্তম্ভ বসিয়ে নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনার কথা খোদাই করেন। তিনি নিজে কীভাবে তার স্বাভাবিক জীবনের অভ্যাস থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছেন, কি করে সংঘের কাজ তিনি তাঁর সাম্রাজ্য ও বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন - এসব সবিস্তারে মাগধী প্রাকৃত ভাষায় খোদাই করিয়েছেন। আবার যেসব এলাকায় মাগধী প্রাকৃত বিদেশী ভাষা সেখানে গ্রীক ও আরামায়িক ভাষায় (গান্ধারের দিকে পারস্য ও গ্রীক অধ্যুষিত এলাকায়) খোদাই করেছেন। একজন সম্রাট যার মুখের কথাই আইন তাঁর থেকে এমন আত্মশুদ্ধির বাণী সে কালে তো বটেই এই যুগেও অসম্ভব। তিনি এছাড়াও স্থাপন করেছেন বহু স্তূপ বা ধ্যানের কেন্দ্র যেগুলো সেই এলাকায় বুদ্ধের তত্ত্ব ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। তাঁর এই ধর্মের প্রচারের জন্য অভিযান তাঁকে পুরো বিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে এক অনন্য আসন দিয়েছে। যেই আদর্শ আজও অনন্য। 

সাঁচির বিখ্যাত স্তূপ [Source: Maps of India]

সারনাথের অশোক স্তম্ভের মাথার সিংহ চতুর্মুখ যা বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রতীক, সিংহের পায়ের নিচে ২৪ স্পোকওয়ালা অশোক চক্র যা ভারতের পতাকার মধ্যে দেখা যায়। চক্রের দুই পাশে চারটি প্রাণীও আছেঃ গরু, ঘোড়া, হাতি ও সিংহ।
[Source: Pinterest]

তিনি কীভাবে কি করেছেন সেটা না বলাই সমীচীন। বিশাল হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং তাঁর প্রচারের পাঁচটি মূলনীতির উপর আলোকপাত করি। যা মূলত বুদ্ধেরই দেখানো পথ। বুদ্ধের আলোয় আলোকিত হবার রাজনীতি। তিনি এই ধর্মের বাণী নিয়ে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তা এই প্রস্তরাদেশ থেকে স্পষ্ট হয়ঃ
"আমার প্রজারা যতক্ষন না ধর্মের পথে থেকে সঠিকভাবে এর চর্চা করবে ততক্ষণ আমার কোন যশ বা খ্যাতিকে আমি বড় করে দেখবো না। সেটা বর্তমান বা ভবিষ্যতে যখনই হোক। আমি কেবল এই এক জিনিসের জন্যই পরিচিতির আশা করি। আর আমি যতকিছু করে যাচ্ছি তার সবই আমার জনগণের কল্যাণের জন্য, তারা যাতে পরের জন্মে আরো কম পাপ করে........." মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ১০
তাছাড়া তাঁর বিখ্যাত অশোক চক্র দ্বারা আসলে জীবন ও ধর্মের ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ দিককে প্রতীকীরূপে দেখানো হয়েছে। এই চিহ্ন তাঁর প্রায় সকল স্থাপনায় পাওয়া গেছে*। আবার অনেকের মতে, এটি কর্তব্যের চক্র। ২৪টি দায়িত্ব পালন করে মানুষ তাঁর জীবন সার্থক করতে পারে। তাই একে 'কর্তব্যের চক্র'ও বলা হয়। এ অর্থটা ভারতের পতাকার ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়।
আবার অনেকে বলে এটি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাকে বুঝায়। তাই একে 'সময়ের চক্র'ও বলা হয়। আবার অনেক পণ্ডিত বলে থাকেন, যে এই ২৪টি স্পোকের প্রথম ১২টি আসলে জীবনের ১২ রকমের দুর্দশার পরিচায়ক। পরের বারটি হল কার্যকারণের প্রতীক। একটি না হলে আরেকটি হবে না। তাই এদের সবগুলোকে মিলিয়ে ধর্মচক্র। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মচক্রে স্পোকের সংখ্যা বিভিন্ন হয়েছে। এবং প্রতিটি চক্র দিয়ে কী বুঝানো হয়েছে তা একেক সময় একেক দিকে গিয়েছে। কিন্তু এই বৃত্তাকার আকৃতির কোন পরিবর্তন আসে নি। তবে ১২টি যে জীবনের দুঃখ-দুর্দশার উৎস এতে কারো দ্বিমত নেই। এগুলোকে প্রতীত্যসমুৎপাদ বলে। এগুলো হলঃ

১-অবিদ্যা (অজ্ঞানতা)

২-সংস্কার (অবচেতন)

৩-বিজ্ঞান (মনন)

৪-নাম ও রূপ (উপলব্ধির স্বরূপ)

৫-ষটেন্দ্রিয় (৬ ইন্দ্রিয়)

৬-স্পর্শ

৭-বেদনা (অনুভূতি)

৮-তৃষ্ণা (আকংখা)

৯-উপাদান (ধরে রাখা)

১০-ভব (অস্তিত্ব)

১১-জাত (জন্ম)

১২-জরমরণ (ব্যাধি ও মৃত্যু)


তো বুদ্ধ দর্শনের ও সেইসাথে অশোকের সত্যের অভিযানে যে পাঁচটি মূলনীতির কথা মেনে চলা হয়েছে সেগুলো হলঃ

অতীন্দ্রিয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যঃ

বুদ্ধের প্রচারিত মতবাদের এটি প্রথম। ব্যক্তি কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিষয়টার মাহাত্ম্য কী? বুদ্ধের মতে, তিনি নিজে এমন এক অস্তিত্ব যা পরিবেশের সকল উপাদানের সাথে, সকল স্তরে যুক্ত। তিনি এমন এক সত্তা যা দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে সবসময় আপেক্ষিক অবস্থায় বিরাজ করে। তিনি দেহধারী কিন্তু সেই দেহে অনুপস্থিত। তিনি অতীন্দ্রিয় কিন্তু অনুভবযোগ্য। এই আধো জানা আধো অজানার মধ্যে ব্যক্তির অবস্থানটা তাঁর পরিচয়কে আরো অর্থবহ করে তুলে। বুদ্ধ একক ব্যক্তিসত্তাকে অস্বীকার করেছেন। কারণ এটি আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি করে। স্বার্থপরতার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আপেক্ষিকভাবে বৃহৎ এক সত্তার অংশ হিসেবে নিজেকে কল্পনা করে নিতে পারলে এই ভুল বুঝাবুঝি হয় না। নিজের থেকে পরের তথা সকলের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

অহিংসাঃ

কোনভাবেই হিংস্রতা বা অত্যাচারের বশবর্তী না হওয়া বুদ্ধের প্রচারিত শিক্ষার অন্যতম অংশ। জীবহত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে। যাতে প্রকৃতির কোন জীবন মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিকারকে অপ্রয়োজনীয় বলা হয়েছে। কারণ এটা অহেতুক হত্যা এবং সেই সময়ে অভিজাতরা শিকারকে অবসর বিনোদন হিসেবে নিতো। শাকাহারী হওয়াকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সম্রাট অশোক চেয়েছিলেন তাঁর সাম্রাজ্যে প্রাণীহত্যা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা হোক। তিনি খোদাই করে দিয়েছেন,
"আমার রসুইয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার প্রাণী হত্যা করা হত কেবল তরকারি রাঁধার জন্য। কিন্তু এখন এই আদেশনামা লেখার সময়ে কেবল তিনটি প্রাণীর জীবন নেয়া হয়েছে। দুইটি ময়ূর ও একটি হরিণ। হরিণটা তাও মাঝে মাঝে। এবং খুব শীঘ্রই এমন দিন আসবে যখন এই তিন প্রাণীও আর মারা হবে না" -মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ১

"...আগে আমি যখন হিংসার আশ্রয় নিয়ে আমার কাজ সারিয়ে নিতাম তখন কোন স্বর্গীয় বা শান্তির চিহ্ন আমি দেখতাম না। কিন্তু এখন অহিংসার পথ ধরার পর থেকে চারপাশে কেবল স্বর্গরথ, ঐরাবতের মতো ঐশ্বরিক প্রতীক দেখতে পাচ্ছি..." - মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ৪

"...এই কাজগুলোকে পাপ বলে গণ্য করা যায়ঃ হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, ক্রোধ, অহংকার - এগুলো দিয়ে আমার ধ্বংস যাতে না হয়..." -  মুখ্য স্তম্ভাদেশ নং ৩

শিক্ষাতত্ত্বঃ

শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া বুদ্ধের আরেকটি সুদূরপ্রসারী চিন্তা। মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য, সর্বোচ্চ উচ্চাশা হওয়া উচিৎ শিক্ষা। কোন একটি চাকরি বা কাজ করার জন্য জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য সীমিত রাখলে আত্মিক মুক্তি সম্ভব না। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে তাই জীবন ও জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। এই হলো বুদ্ধের শিক্ষা। ধর্ম। 
অশোক এই শিক্ষাটাকে তাঁর রাজত্বের কোনায় কোনায় তো বটেই, তাঁর চেনা জানা সকল এলাকায় ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হন। দিকে দিকে ধর্মের বাণী নিয়ে তিনি সন্ন্যাসী, পণ্ডিত, দূত পাঠান যাদের মূল কাজ ছিল বুদ্ধের বাণী প্রচার করা। ধর্মের শিক্ষা তিনি পাথরে খোদাই করে সাম্রাজ্যের সব জায়গায় বসিয়ে দেন। স্তূপ আর সংঘে দান তো আছেই। এসবের ফলে শিক্ষার নবজাগরণ ঘটে অশোকের আমলে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। ধর্মের সঠিক পথের সন্ধান পেলে সামগ্রিক উন্নতি হবে। জগতের, মানুষের, সমাজের। 
"আমার রাজত্বের প্রতিটি অংশের শাসকদের পাঁচ বছর পর পর ধর্ম প্রচারের (ও অন্যান্য সকল কাজের) জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সফর করতে হবে। তাঁদের যে শিক্ষাগুলো প্রচার করতে হবে তা হলঃ
পিতামাতার প্রতি ভক্তি প্রশংসনীয়, 
বন্ধু, স্বজন, পরিচিত, ব্রাহ্মণ ও সন্ন্যাসীদের প্রতি উদারতা প্রশংসনীয়,
জীবহত্যা থেকে বিরত থাকা প্রশংসনীয়,
ব্যয় ও সম্পত্তি অর্জনে পরিমিত হওয়া প্রশংসনীয়......" - মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ৩

"ধর্মের পথ সবচেয়ে বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এখন ধর্মের কাজ কী কী? এগুলো হলঃ পাপের কাজ কম করা, অনেক নৈতিক ভালো কর্ম, সমবেদনা, উদারতা, সত্যবাদিতা ও মনের শুদ্ধতা..." - মুখ্য স্তম্ভাদেশ নং ২ 

উল্লেখ্য, তাঁর ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি মহামাত্র বা মন্ত্রীও নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাদের কাজ ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বা দর্শনের ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি জৈন, ব্রাহ্মণ ও অজীবক সন্ন্যাসীদের সরাসরি দেখভাল করা।

নিঃস্বার্থ পরোপকারিতাঃ 

এই নীতিটি বুদ্ধের দর্শনে এক উদারতম মাত্রা। নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা বা ভালোর চেয়ে অন্যের ভালো বা সুবিধাকে এগিয়ে রাখা। এই উদ্দেশ্যে কাজ করা। একান্ত নিজের জন্য কিছু না করে সমাজের সকলের সমষ্টিগত স্বার্থকে আগে মূল্যায়ন করার মহৎ মন্ত্র আয়ত্ত করতে পারলে নিজেরই লাভ। ধর্মের এ বিধান নিজের উন্নতির জন্যই। নৈতিকতায় উচ্চতর শাখায় আসীন হতে পারলে সংসারের চক্র হতে মুক্তি সহজ হয়। আর অশোক এই নীতিকে ব্যক্তি পর্যায় ছাড়িয়ে একদম সম্রাট পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের যেকোনো কাজে, সিদ্ধান্তে তিনি প্রজাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সাম্রাজ্যের কোন ক্ষতি করতেও তিনি পিছপা হতেন না। এইরকম বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও প্রজাবৎসল সম্রাট-খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অতীতে এবং বর্তমানে। 
"আগে রাজ্য সম্বন্ধীয় কোন সংবাদ বা দরকারি খবর সম্রাটকে সবসময় দেয়া হতো না। কিন্তু এখন আমি আদেশ দিচ্ছি, যদি আমি খাওয়ার মাঝে থাকি, বা নারীদের মহলে থাকি, অথবা শোয়ার ঘরে থাকি, কিংবা রথে/পালঙ্কে/বাগানে - যেখানেই থাকি না কেন কর্মচারীরা প্রজাদের কোন সংবাদ বা রাজ্যের কোন প্রতিবেদন নিয়ে যে কোন সময়ে, যে কোন জায়গায় আমার কাছে আসবে। যাতে আমি সবসময় সেদিকে নজর রাখতে পারি। আর যদি মহামাত্রদের (ধর্ম প্রচার, নীতি নির্ধারণের জন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) মাঝে আমার দেয়া কোন নির্দেশ, কাজ নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয় তবে সেটা যেন আমাকে অবিলম্বে জানানো হয়..." - মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ৬

সাম্যবাদঃ

গৌতমের সময় থেকে সংঘের নিয়ম ছিল যেকোনো গোত্রের, ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের মানুষ সত্যের অন্বেষণে যোগ দিতে পারবে। এবং এই ব্যবস্থায় সম্মান পাবার ভিত্তি ছিল আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আগে সংঘের সদস্য হয়েছে সে শূদ্র বা অচ্ছুৎ গোত্রীয় হলেও পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় যোগদান করলেও তাকে সেই শূদ্র ব্যক্তিকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এমনকি ২০ বছরের লোকও যদি আগে যোগ দিয়ে থাকে তবে সে পরে যোগ দেয়া ৬০/৭০ বছরের কারো থেকে প্রাধান্য বেশি পাবে। এই সর্বব্যাপিতা বুদ্ধ দর্শনকে দিয়েছে সব স্তরে গ্রহণযোগ্যতা। সংঘের আকার বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। তিনি সংঘের প্রতি সদস্যকে যার যার কর্তব্য সম্পর্কে জানিয়ে দিতেন। ফলে ভেদাভেদ হবার সুযোগ হত না। 
অশোক তাঁর ধর্মের অভিযানে এই সাম্যবাদটাকে আরো প্রকট করে তুলেছিলেন। দিনকে দিন তিনি হয়ে উঠছিলেন প্রজাদের রাজা। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতার মতো উদার নীতি তিনি নিয়েছিলেন। যদিও তিনি নিজে বিশাল আয়োজন করে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার করে যাচ্ছিলেন, তারপরও তিনি অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মমতের বিরোধিতা করেন নি। বরং শান্তির সাথে সকল মতবাদের সহাবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে তিনি প্রজাবান্ধব সম্রাট হিসেবে তাঁর পুরো সাম্রাজ্যে ও বিদেশে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রস্তর ও স্তম্ভের আদেশ থীক জানা যা তিনি ব্রাহ্মণ, অজীবক ও জৈন সন্ন্যাসীদের সংঘেও নিয়মিত দান করতেন।
"সকল গোষ্ঠীর উন্নতি হওয়া জরুরি। এবং তা অনেক উপায়েই করা যায়। কিন্তু এর মূলটি রয়ে গেছে কথার লাগামে। মানে, কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া নিজের ধর্মকে বড় করে দেখানো এবং অন্যের ধর্মকে ছোট করা। যদি সমালোচনার কিছু থেকেও থাকে সেটা নরমভাবে করা। কিন্তু এজন্য অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করাটাই ভাল। এর মাধ্যমে নিজের ও অন্যের ধর্মেরই ভাল হয়। আর এক অপরের ধর্মকে সম্মান না করলে দু ধর্মেরই ক্ষতি হয়। কেউ যদি অন্ধভক্তির কারণে নিজের ধর্মের সম্পর্কে অতি উৎসাহী হয়ে অন্য ধর্মের লোককে নিন্দা করে আর বলে 'আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ' তবে সে নিজের ধর্মেরই ক্ষতি করে... সকলের উচিৎ অন্যদের মতামত ও চিন্তাধারা মনোযোগ দিয়ে শোনা......" - মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ১২
"সম্রাট চান, যেন সব ধর্ম সব জায়গায় থাকে। কেননা প্রতিটি ধর্মই চায় আত্মসংযম ও হৃদয়ের শুদ্ধতা। কিন্তু অনেক চিন্তাধারার ও মন-মানসিকতার মানুষ আছে যারা হয় তাঁর ধর্মের পুরোটা গ্রহণ করে বা কিছু অংশ নেয়। তাই যারা এমন মহান শিক্ষা পেয়েও কৃতজ্ঞতা, সংযম, শুদ্ধাচারের চর্চা করতে পারে না, তারা অধম।" - মুখ্য প্রস্তরাদেশ নং ৭ 

এতো উদার রাজ্যনীতির কুফলও কিন্তু আছে। ক্ষমতার কাছের লোকগুলো কিন্তু এতোটা উদারভাব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। অশোকের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীরা চেয়েছিল আবার আগের মতো রাজ্য বাড়ানোর অভিযানে নেমে পড়তে। কিন্তু অশোক তা মোটেও চাননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সমগ্র সাম্রাজ্য তিনি সংঘকে দিয়ে যাবেন! 
সম্রাটের এই স্বেচ্ছাচারিতায় ভীত হয়ে তাঁর উত্তরাধিকাররা (পুত্র, দৌহিত্র) মন্ত্রীদের সহায়তায় তাঁকে এক ঘরে বন্দী করে রাখে। কিন্তু তিনি সংকল্প থেকে টলতে রাজি হননি। তাঁকে দেয়া খাবার হতে আমের একটা বড় খোসা নিয়ে অশোক নিজ শরীরের রক্ত দিয়ে লিখে ফেলেন তাঁর সম্পত্তির উইল। 
"আমি, সম্রাট অশোক, সুস্থ চিত্তে আমার সাম্রাজ্যের সকল সম্পত্তি সংঘগুরু উপগুপ্তকে দিয়ে যাচ্ছি।" 

বলা হয়, এই আমের খোসার উইলে অশোক তাঁর সিংহ সিলও লাগিয়ে ছিলেন। তাঁর দাঁতের সাথে ছোট একটা সিংহের মাথার নকশার টুপি লাগানো থাকতো। এটাই তাঁর দপ্তরের সিলমোহর ছিল। তিনি আমের খোসার উপর কামড় দিয়ে সেই সিল দিয়ে দেন এবং সংঘের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। একদিন তাঁর জানালার কাছ দিয়ে সংঘের এক দল মুষ্টিভিক্ষার কাজে বের হয়েছে। তিনি জানালা দিয়ে তাঁর আমের খোসার উইল ছুঁড়ে মারেন। সন্ন্যাসী সেটি উপগুপ্তের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু উপগুপ্ত বুঝতে পারে এই নির্দেশ মেনে নিলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাছাড়া এতো অর্থ-সম্পদ ব্যবস্থাপনা করার জন্য ইচ্ছা, ধর্মীয় অনুশাসন, জ্ঞান কোনটাই তিনি বাস্তবিক বলে মানতে পারলেন না। ফলে তিনি সেই উইল নিয়ে মন্ত্রীদের কাছে এলেন ও এই উইল প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে অশোকের জাগতিক সম্পদ সংঘের উন্নয়ন কাজে ব্যয় হবার ইচ্ছা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

এগুলো ছাড়াও অশোকের সময়ে সংঘগুলোতে সহজিয়া রীতির পদ বানিয়ে গান গেয়ে পরিবেশন করা হতো বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা দিয়ে থাকেন। 

"পদ্মের পাতায় পানি যেমন, যেমন সুঁইয়ের ডগায় সরিষা,

ব্রাহ্মণ বলি তাঁরে - যেজন তেমনি ধরে রাখে সুখটারে।"

আবার-

"সর্বোচ্চ প্রাপ্তি স্বাস্থ্য, সন্তুষ্টি হলো শ্রেষ্ঠ ধন,

কাছের আত্মীয় বিশ্বাস আর সেরা সুখ নির্বাণ।"


তবে অশোকের এই বুদ্ধনীতি প্রচারের বড় একটা প্রভাব পড়ে সাম্রাজ্যের প্রতিরোধ ব্যবস্থায়। সক্রিয় সেনার সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাঁর মৃত্যুর ৪০-৫০ বছরের মাঝে মৌর্য সাম্রজ্যের পতন ঘটে বাইরের ও ভিতরের শত্রুদের আক্রমণে। তবে সংঘ সমাজ বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ ধরে।


বুদ্ধ মতের যুগে যুগে বিবর্তন

রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধের ভক্তদের মাঝে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। ফলে তাঁর নিয়মিত অর্থ সহায়তার দরুন সেই সময় থেকেই বুদ্ধ ধর্মমত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অশোকের কারণে সেটা ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে চলে আসে। এরপর কুষাণদের (৩০-৩৭৫) সময়েও এ ধারা অব্যাহত থাকে। গান্ধার (কান্দাহার), লঙ্কা ও বিহার হয়ে থাকে বৌদ্ধ মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র। গুপ্তদের (৩২০-৫৭০) সময়ে এই দর্শন আরো জৌলুস প্রাপ্ত হয়। কারণ সেই সময়ের দার্শনিক চিন্তাভাবনার কেন্দ্র হয়ে উঠে বিহার গুলো। এবং গুপ্ত রাজাদের অনেক অমাত্যই বিহার থেকে শিক্ষিত হতেন। ধারণা করা হয় নাগার্জুন (৩য় শতাব্দী), আর্যদেবের মতো চিন্তাবিদের মতবাদের কারণে উদ্ভব হয় মহাযান বিভাগের।এটা প্রথম সহস্রাব্দের প্রাথমিক অর্ধেকের কথা, মানে ৫০০ অব্দের আগ পর্যন্ত। হীনযান (পূর্ব এশিয়াতে থেরোবাদকে হীন বলা হয় কারণ, থেরোবাদ অনুযায়ী অরহৎ প্রাপ্তি পুরোপুরিভাবে নিজের কঠোর তপস্যার উপর নির্ভর করে। এরপর অন্যের মাঝে সে জ্ঞান বিতরণ আবশ্যক না। অপরদিকে মহাযানীদের বোধিসত্তা অর্জনের পর এই আধ্যাত্মিক সত্তার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সে বাদবাকি জগতের উন্নতি সাধনের জন্য পরিনির্বাণ আরো পিছিয়ে দেবে। জগতে আরো কিছু সময় থেকে সকলের মাঝে এই মহান জ্ঞান বিলিয়ে দেবে। সাধারণকে পথ দেখাবে) বা থেরোবাদ বা আত্মকেন্দ্রিকযান মতবাদের অরহৎ বা নির্বাণ পাওয়া সত্তার পাশাপাশি মহাযানীদের বোধিসত্ত্বার ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দুই শাখার মধ্যে আপাত কোন ঝামেলা সেই প্রথম সহস্রাব্দে ছিল না। বিহারসহ সারা ভারতেই নানা বৌদ্ধবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। এসব বিদ্যালয়ে চলতে থাকে অভিধর্মের চর্চা। বিভিন্ন মতবাদের ভিক্ষুরা একসাথে অবস্থান করে ও নানা বিষয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক আলোচনা এখানে চলতে থাকে। চীন-তিব্বতসহ দূর-দূরান্ত থেকে ভিক্ষুরা এখানে পাঠ নিতে আসে। হাজার হাজার বিদ্যাপিপাসু এসব বিহারে বছরের পর বছর দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ভাববাদ, বিজ্ঞান, বৌদ্ধ মতবাদসহ রাজ্যচালনার বিদ্যাও শিখত। সেই সাথে অন্যান্য ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ চলতে থাকে দেদারসে। এই অনুবাদের জন্যই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও সিদ্ধার্থের শিক্ষা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নি। তিব্বতি ও চৈনিক ভাষায় এর পরবর্তী গবেষণা ও নতুন সংযোজন চলতে থাকে। 
পালদের (৭৫০-১১৫০) সময়ে (ভারতের শেষ বৌদ্ধ সাম্রাজ্য) যদিও বৌদ্ধদের এক নবজাগরণ শুরু হয় কিন্তু সেটা পূর্ব ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাছাড়া গুপ্ত পরবর্তী সহিংসতায় পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মনত্বের উত্থান ঘটে। হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের (৭ম শতাব্দী) সময়ে এসে এই অবস্থা দেখেন। তিনি নালন্দা ও বাংলাদেশের নানা জায়গায় তখন বৌদ্ধ ধর্মের স্ফুরণ দেখতে পান। তাছাড়া ৬০০ অব্দের পরই মূলত তিব্বতী বজ্রযান বা তন্ত্রযান মতবাদের উদ্ভব ঘটে। এই মতবাদ অনুসারে, যে কেউ যে কোন সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে মহাসিদ্ধ (মহাযানী বোধিসত্ত্ব ও থেরোবাদ অরহৎ) হতে পারে। কিছুটা Crash Course to Buddhahood বলা যায়। 
বজ্রযান ধারার একটি বিখ্যাত ধারা হল কদম শাখা (দ্বাদশ শতাব্দী) যার শুরু হয়েছিল দ্রোমতোন ভিক্ষুর হাত ধরে। এই কদম মতধারা তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত  জে সংখাঁপা (পঞ্চদশ শতাব্দী) এই তিন ধারা একীভূত করে চালু করেন গেলুগ শাখা। এটিই সবচেয়ে আধুনিকতম শাখা বৌদ্ধত্বের। এই শাখারই বর্তমান ধর্ম ও রাজনৈতিক গুরু হলেন ১৪তম দালাইলামা। তেনজিং গ্যিয়াতসো। আর সেই কদম শাখার প্রচারক দ্রোমতোন ছিল বাংলার বৌদ্ধ গুরু অতীশ দীপঙ্করের সবচেয়ে কাছের শিষ্য। এই দ্রোমতোনপা শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের এতো ভক্ত ছিলেন যে, যে ১২ বছর অতীশ তিব্বতে থেকেছেন সেই সময়টা দ্রোমতোনপা একটি প্রদীপ তাঁর কাছে রেখে দিয়েছিলেন। ভ্রমণে, শয়নে - সবসময় তিনি সেটা জ্বালিয়ে রাখতেন।
উল্লেখ্য, এই সময়ের কিছুকাল পরেই ভারত, বৌদ্ধ মতবাদের জন্মস্থল হতেই এর মূল উৎপাটিত হয়।

আর সেইসময়ে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠে তিব্বত ও চীন ও জাপান। সেখানে স্ফুরিত হয় নতুন নতুন শাখা। নিচিরেন (জাপানের মহাযানী ধারা যে মতে যে কেউ এক জীবনেই বুদ্ধ হতে পারবে কেননা সবার মাঝেই এমনিতেই সুপ্ত বুদ্ধ আছে), জেন (চীনে উদ্ভূত এই ধারায় কঠোর সন্ন্যাসব্রত পালন করতে পারলে একজন গুরুর সাহচর্যে থেকে নির্বাণ পাওয়া সম্ভব), বুদ্ধক্ষেত্র বা পিউর ল্যান্ড (চীন হতে উদ্ভূত এই শাখার মূল কথা হলো এই পার্থিব জগতে সম্পূর্ণ কলুষতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। একজন পথপ্রদর্শক দরকার। তাই আমাদের যেতে হবে অমিতাভ বা পূর্ববর্তী একজন বুদ্ধের বুদ্ধক্ষেত্রে বা Pure Land এ। সেখানে অমিতাভ হতে বোধিসত্ত্বের শিক্ষা নিয়ে নির্বাণ পেতে পারে), গেলুগ, কাগ্যু (প্রচুর প্রতীকী দেবতার উপস্থিতি পাওয়া যায় এই তান্ত্রিক তিব্বতি বৌদ্ধ শাখায় যেখানে মূল হল নারোপার ছয় শিক্ষা। এই নারোপা আবার তিলোপার প্রধান শিষ্য। তিলোপা বাংলার চট্টগ্রামের এক সিদ্ধপুরুষ। এক মহাতান্ত্রিক) - এসব বিখ্যাত শাখা মূলত মহাযান ও বজ্রযান ধারার থেকে উৎসারিত নতুনতম মতবাদ। 
বর্তমানে মহাযান মতবাদের অনুসারী বেশি হলেও বজ্রযান মতবাদের জনপ্রিয়তাটা পশ্চিমা বিশ্বে বেশি। তার কারণ দালাই লামা। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত এই ধর্মগুরুর পাশ্চাত্যে অনেক বেশি প্রচারণা হয়েছে।  মূলত আমেরিকার চীনের মাওবাদী মতবাদের জবাব দেয়ার জন্য। তাছাড়া শান্তির ধারা ও উচ্চ মানবিক মূল্যবোধের জন্য সহজেই সাধারণ জনগণের মাঝে এই লোকটির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। 

আর একটি বিষয় না বললেই নয়। তা হলো, বজ্রযানের একটা প্রধান বিষয় হলো - বুদ্ধ দর্শনের সকল ধারার মধ্যে কেবল এই ধারাই বলে - এক জন্মের মধ্যেই বোধিচিত্ত অর্জন করা যায়। কঠোর সাধনা ও তীব্র জ্ঞানচর্চা ও কর্মের ফলে সেই অবস্থা লাভ করা যায়। যার ফলে, তিব্বতের এই ধারার জনপ্রিয়তা কমে নি কখনো।

জন্মভূমিতে বৌদ্ধ দর্শনের বিলোপঃ

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র ভারতে যে মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাঁর থেকে শুরু হয় সাম্রাজ্য বিভাজন। সারা ভারতবর্ষ ছোট ছোট এলাকায় ভাগ হয়ে পড়ে। এবং সেই সাথে সেই মৌর্য আমল থেকে চলে আসা সংঘসমূহে রাজাদের দেয়া দানের পরিমাণ কমে যায়। সে জায়গায় ব্রাহ্মণ ধর্মের প্রতি শাসকদের মনোযোগ চলে যায়। ফলে উপনিষদ ও বৈদিক-পুরাণ চর্চা এসময়ে নতুন জীবন লাভ করে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে। পূর্ব বাংলায় সেই সময়ে পালদের উত্থানের কারণে বৌদ্ধ বিপ্লব পূর্ব ভারতে চলে আসে। পাল রাজারা নিজেরাও বৌদ্ধ মতাবলম্বী হওয়াতে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধচর্চা চলতে থাকে। সোমপুর, শালবন বিহার এসবের থেকে যাওয়া শেষ চিহ্ন। নালন্দাতে তখন চলতে থাকে তান্ত্রিকতার বিকাশ। তিব্বতের সাথে যোগাযোগ বাড়ে এবং এই ধারা মানে বজ্রযান ধারার ভিত্তি গড়ে উঠতে থাকে। 
প্রখ্যাত পণ্ডিতেরা পাড়ি জমান হিমালয় ছাড়িয়ে আর ধীরে ধীরে ভারতের কেন্দ্রস্থলে আসতে শুরু করে তুর্কি, আফগানি বিজেতার দল। মুসলিমদের এই প্রথম স্রোতে আসে কিছু কঠোর প্রকৃতির সেনাপতি। যারা নির্বিচারে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভেঙে দেয় ও বইপত্র নষ্ট করে। হাজার হাজার ভিক্ষুর সমাবেশ হতো বিহারগুলোতে। কিন্তু তাঁরা অহিংসাব্রত নিয়ে লক্ষ লক্ষ দাহ্য বই নিয়ে অস্ত্র ছাড়া সেইসব জায়গায় অবস্থান করতো। ফলে জাত্যাভিমানে উদ্ধত এই তুর্কি মুসলমানদের জন্য খুব সহজ শিকার হয়ে পরে এসব বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষুরা। ইখতিয়ারউদ্দিন নালন্দার বিখ্যাত বিহার ধ্বংস করেছিল বলে অনেকে মনে করলেও এর বিরুদ্ধ মতবাদও আছে। বিহারগুলোর সাথে সাথে বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার -গ্রন্থাগারগুলো- হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। আল বিরুনি, আল ফারাবী আর ইবনে সিনার মতো চিন্তাবিদেরা যেমন এই প্রাচ্যের অনেক জ্ঞানের প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন, সেখানে সেইসব জ্ঞানের আধার বইগুলোকে এসব তৃণভূমি বা মরুভূমির উদ্ধত সামরিক শাসকেরা যথাযথ মর্যাদা দেয় নি - এতে আফসোস করা ছাড়া বেশি কিছু করার থাকে না। তাঁরা এর মূল্য বুঝতে সমর্থ ছিল না সেই সময়ে। যেই সময়ে ধর্মের নামে হাজারে হাজারে মানুষ হত্যা করে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো, তাঁরা দর্শনের চর্চার মাধ্যমে আত্মিক উন্নতির গুরুত্ব অনুধাবন করবে না - এটা না বুঝতে পারাটাও এই যুগে বসে বোকামি। আর না মানতে পারাটা সঙ্কীর্ণতা। ইতিহাসের প্রতিটি সময়ের আলাদা আলাদা নিজস্ব প্রভাবক ছিল। এখনো আছে। বড় কোন শক্তির ক্ষমতার হাতবদলে পুরো বিশ্বে অভাবনীয় সাড়া পড়ে যায়। আর সেই সাথে পরবর্তী বছরগুলোর গতিপ্রকৃতিও বদলে যায়। এই বিষয়টা আগেও ছিল। এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।


তিব্বতে বৌদ্ধবাদঃ

দর্শনটির জন্মস্থল একে ধরে না রাখতে পারলেও হিমালয় পাড়ি দিয়ে এটি প্রধান আকর্ষণ হিসেবে জায়গা করে নেয়। এর পেছনে অনেকগুলো ব্যাপার কাজ করেছে। কেন পূর্বে বা পশ্চিমে না ছড়িয়ে হিমালয় পাড়ি দিয়ে উত্তরে এতো উঁচুতে বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার লাভ করলো। এর জন্য দায়ী রাজা সোংসেন গামবো। তিনি ভারত থেকে বৌদ্ধবাদের বই নিয়ে আসতে থাকেন ও তিব্বতি ভাষায় শুরু হয় এর অনুবাদ। এর কাজ শুরু হওয়ার জন্যই পরে যখন অনেক বই হারিয়ে যায় ভারত থেকে, সেগুলোর অস্তিত্ব তিব্বতে বহাল তবিয়তে পাওয়া যায়। আর এই ভাষান্তর করার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশার সৃষ্টি হয়। লোৎসাওয়া। বা অনুবাদক। এর আক্ষরিক অর্থ বিশ্বের চোখ। মানে তাবৎ বিশ্ব থেকে আহরিত জ্ঞানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। আর এই লোৎসাওয়ারাই পরবর্তীতে বিভিন্ন মতধারার প্রচারক ও বাহক হিসেবে তিব্বতে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও আলোচিত পদ্মসম্ভব ও রিনচেন জাংবো। তিব্বতের প্রতিটি শাখাই কোন না কোন তন্ত্র সাধনা করে থাকে। বজ্রযান এসেছে এই তান্ত্রিক যোগসাধনা থেকেই। আর প্রতিটি শাখার পদ্ধতি নিয়ে মূল খুঁজতে গেলে কোন না কোন মহাসিদ্ধ বা তন্ত্রসাধকের লেখার রেফারেন্স পাওয়া যায়। 

পদ্মসম্ভবকে তিব্বতে অন্য রকমের সম্মান দেয়া হয়। অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতের রাজা ত্রিসোন ডেটসেনের আমন্ত্রনে তিব্বতে আসেন ও তাঁর সময়েই তিব্বত বর্ণমালা ও ব্যাকরণের কাজ করা হয় যাতে সংস্কৃত থেকে এ ভাষায় বৌদ্ধ মতবাদের কথাগুলো নিয়ে আসা সহজ হয়। এই পদ্মসম্ভবকে তিব্বতে দ্বিতীয় বুদ্ধ বলা হয়। তাঁকে গুরু রিনপোচে নামে সম্মানিত করা হয়। তিব্বতে অনেক জন রিনপোচে (মানবরত্ন) আছেন। কিন্তু কেবল রিনপোচে সম্বোধনে তিনজন সাধককে একনামে সবাই চিনে। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলো এই পদ্মসম্ভব। গুরু রিনপোচে। আর বাকিরা হলেন, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর বা জো রিনপোচে এবং জে সংখাপা বা জে রিনপোচে - যিনি গেলুগ শাখার আদিপুরুষ।

তিনজন রিনপোচে [Source: Gar Drolma, Garywonghc, Universal Compassion Foundation]


এই পদ্মসম্ভব উড়িষ্যার মানুষ ছিলেন*। এবং তাঁর করে যাওয়া কাজের উপর ভিত্তি করে ন্যিংমা মতবাদের শুরু হয়। ন্যিংমার আক্ষরিক অর্থ প্রাচীন। কারণ এটি তিব্বতি বজ্রযানী ধারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো। এই ধারার মতে, যোগচেন বা অতিযোগের মাধ্যমে বুদ্ধচিত্ত অর্জন করা যায়। মোক্ষ লাভ করতে হলে, ন্যিংমা মতানুসারে, এই অতিযোগের মাধ্যমে অসামান্য পরিপূর্ণতা লাভ করতে হবে। আর তার জন্য দরকার অতি সূক্ষ্ম মনোযোগ সহকারে মনের মধ্যে ছবি জাগিয়ে তুলে যোগসাধনা করা। তন্ত্রের চর্চা করা। এই ন্যিংমা মতবাদের সকল ধারার আদিপুরুষ হিসেবে পদ্মসম্ভবকে মেনে নেয়া হয়।

সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয় নানাবিধ বৌদ্ধ মতবাদ। কাগ্যু ধারা, যা চট্টগ্রামের স্থানীয় তিলোপার শিষ্য নারোপার থেকে তিব্বতে নিয়ে আসেন মারপা,আরেকজন লোৎসাওয়া। মহামুদ্রার এই শিক্ষাকে জনপ্রিয় করেন মিলারেপা যিনি তাঁর গুরু মারপাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে কাগ্যু ধারাকে তিব্বতের সবচেয়ে বড় শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। উল্লেখ্য, এই মিলারেপা সিদ্ধ হবার আগের জীবনে অত্যন্ত রাগী ও রুক্ষমেজাজি ছিলেন। ৩৫ খুনের দাগ ছিল তাঁর নামে। কিন্তু তিনি এতোটাই বুঁদ হয়ে বুদ্ধ তপস্যায় লেগে যান যে, তিনি এক জীবনের সময়েই বোধিসত্ত্বা অর্জন করেন। এই অর্জন তান্ত্রিক ধারাকে আরো মজবুত করে এবং মিলারেপা হয়ে উঠেন কিংবদন্তী। মিলারেপা তাঁর শিক্ষাগুলোকে পদাকারে গাইতেন। অনেকটা চর্যাপদের সহজিয়া পদাবলীর মতো। একই ধারণা প্রসূত। কেননা বজ্রযানী ধারনাগুলোর বেশিরভাগ উৎস ছিল বাংলার সিদ্ধরা যারা বিহারগুলোতে শিক্ষাগুরুর কাজ করতেন। এই মিলারেপা নিয়ে অদ্ভুত কাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি নাকি বাতাসের বেগে উড়ে বেড়াতে পারতেন। আবার তিনি নাকি হিমালয়ের মাথায় গিয়ে কেবল একটি সুতি কাপড় গায়ে জড়িয়ে তপস্যা করতেন। তাঁর ছিল ৫টি বিশেষ তান্ত্রিক যোগশিক্ষা। 

1. Magic body                                     2. Inner fury fire                                 3. Lucid dream yoga                                4. Death soul ejection                         5. Clear light immersion 

এই কাগ্যুধারার আবার কিছু শাখা আছে যার একটি হল কারমা। এই শাখার মাহাত্ম্য হলো, ত্রয়োদশ শতকে এই কারমা ধারাতেই বৌদ্ধ মতবাদে পুনর্জন্মের ঘটনা ঘটে প্রথমবারের মতো। কর্মপক্ষী, এক বিস্ময়বালকের জন্ম হয় যে আগের কারমাপার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিখুঁতভাবে খুঁজে নেয় ও সংঘে যেয়ে তাঁর শিষ্যদের বৌদ্ধ মতবাদের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। এই অভূতপূর্ব ঘটনার জন্য তাঁকে দ্বিতীয় কারমাপা হিসেবে মেনে নেয়া হয় এবং পুনর্জন্মের এই ব্যাপারটা বজ্রযানে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই বারংবার পুনর্জন্ম নেয়ার ধারাটিকে তখন অবলোকিতেশ্বর বা চেনরেজিগের অবতার হিসেবে ধারণা করা হয়। এই অবলোকিতেশ্বর একজন প্রখ্যাত বোধিসত্ত ছিলেন। যুগে যুগে এই অবতারের আগমনের কারণে মানুষ দিকভ্রষ্ট হওয়া থেকে নিস্তার পায়। এবং একই সাথে একজন মূর্তমান বোধিসত্ত নিজেদের সমাজে, মানুষের মাঝেই বিরাজমান আছে - এই ধারণা মানুষের মনে সাহস যোগায় ও ভরসা দেয় যে, তারাও এক জীবনেই বোধিসত্ত অর্জনে সক্ষম হতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো শাক্যধারা। এই ধারার মাহাত্ম্য হলো এই শাখার মাধ্যমেই মঙ্গোলিয়ার সাথে তিব্বতের প্রগাঢ় সম্পর্ক শুরু হয়। এর প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয় পাঁচজন মহামুনিকে। সাচেন কুঙ্গা, সোনাম সেমো, জেৎসুন দ্রাগপা, শাক্য পণ্ডিত, ফাগপা। এই ফাগপা কুবলাই খানের (চেঙ্গিস খানের নাতি যিনি চীনে ইউয়ান রাজবংশের শুরু করেন) ধর্মীয় গুরু ও উপদেষ্টা ছিলেন। এই সময় থেকেই তিব্বতে ধর্মীয় গুরু রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন কারণ কুবলাই খান তাঁকে এই সুযোগ করে দেন।

বিরূপা শাক্য ধারার মতবাদের একজন বিখ্যাত সাধক। তাঁর প্রচারিত শিক্ষা থেকেই শাক্য ধারার মতবাদগুলো এসেছে বলে ধারণা করা হয়। তিনিও বাঙালি ছিলেন। বলা হয়, তিনি এক শুঁড়িখানায় যেয়ে মদ খেতে চান এবং এর খরচ সূর্য ডুবার পর চুকিয়ে দেবেন এই শর্তে খাওয়া শুরু করেন। কিন্তু বিকেলের পর তিনি আঙ্গুলের ইশারায় সূর্যকে ডুবা থেকে আটকে রাখেন। ফলে রাজা এসে তাঁর মদের খরচ চুকিয়ে দিলে তিনি ঠাণ্ডা হন। 

বিরূপার সূর্যাস্ত আটকে দেবার বিখ্যাত ঘটনা [Source: Pinterest]

সবচেয়ে নতুন ধারার নাম গেলুগ। যা মূলত অতীশ দীপঙ্করের শিষ্য দ্রোমতনের প্রচারিত মতামত থেকে নেয়া। কদম ধারা খুব শীঘ্রই আলাদা আলাদাভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। কোনটা আদিগুরুর মুখের কথার সূত্র ধরে, কোনটা লিখে রাখা সূত্র ধরে। এগুলোকে একীভূত করে ও অন্যান্য ধারার উল্লেখযোগ্য কিছু শিক্ষা নিয়ে জে সংখাপা চালু করেন গেলুগ ধারা সেই চতুর্দশ শতাব্দীতে। তিনি এই মতধারার শিখাগুলো লিখে যান তাঁর লামরিম চেনমো নামের বইয়ে। এই বইটির মূলতত্ত্ব আছে অতীশ দীপঙ্করের বোধিপথপ্রদীপ নামের সংস্কৃত বইয়ে। জে রিনচেন বলেন, বোধিসত্ত অর্জনের জন্য মানুষের দরকার তিনটি পথ অবলম্বন করা - সংসার ত্যাগের ইচ্ছা, সকল জীবের জন্য বোধিচিত্ত অর্জন করা [মহাযান তত্ত্ব], শূন্যতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারা। এগুলোর সাথে বজ্রযান ধারার ধ্যানের অবলম্বন করার মাধ্যমে দ্রুত বোধিচিত্ত অর্জন করা সম্ভব বলে জে সংখাপা মত প্রকাশ করেন।

তিব্বতি বৌদ্ধ মতবাদ এতো বেশি পথ-মতবাদ-চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে বছরের পর বছর নানাভাবে রূপ নিয়েছে যে সবগুলোর সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা অর্জন করা ও এখানে আলোচনা করা অসম্ভব। তাছাড়া, বিভিন্ন বৈদিক ও তিব্বতের স্থানীয় দেবতাদের সংযোজনে এই ধারাটি হয়ে উঠে চরম বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে একটি কথা সাধারণভাবে বলা যায় যে, তিব্বতের সকল বৌদ্ধ মতবাদের প্রধান লক্ষ্য হলোঃ প্রজ্ঞাপারমিতা বা চরম জ্ঞান লাভ করে, তন্ত্রে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে সংসারের চক্র থেকে মুক্তি লাভ করা। বোধিচিত্ত অর্জন করা।

আর একই সাথে তিব্বতের বৌদ্ধ মতবাদ বাকি অন্য যেকোন জায়গা থেকে ভিন্ন কারণ এটিই একমাত্র জায়গা যেখানে শত শত বছর ধরে সকল জনগণ একসাথে একই রকম আধ্যাত্মিক মনোভাব নিয়ে বৌদ্ধ দর্শনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার থেরোবাদ ও পূর্ব এশিয়ার মহাযান - এসব জায়গায় সামাজিক ও আত্মিক ধারণায় বুদ্ধ যেভাবে ঢুকে আছে তার চেয়ে বহুগুণে প্রভাবান্বিত তিব্বতিরা। দলে দলে নিজের ইচ্ছায় সামরিক আগ্রাসনের থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ ভাবে কৃষিকাজ ও পশুচারনার মাধ্যমে জীবিকা ও জীবন নির্বাহ করে যাওয়া এই তিব্বতিরা প্রকৃতার্থে উচ্চতর মানসিকতা ও সভ্যতার জানান দেয়। নারীর সমতা, সম্পদের বণ্টন ও বস্তুবাদে আসক্ত না হয়ে ভাববাদ-বৌদ্ধবাদে বুঁদ হয়ে থেকে সংসার থেকে মুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এর মাধ্যমে নির্ঝঞ্ঝাট একটি উন্নত জীবন ধারণ করা সম্ভব। আর সেই উদ্দেশ্যেই তিব্বতিদের সংগ্রাম। এটা সত্যি যে গণহারে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার মাধ্যমে যেকোন দেশ বহিরাগত সেনা হামলার বিপক্ষে একদম দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু এটাই তিব্বতি বৌদ্ধদের ইচ্ছা। এতেই ওদের আত্মিক উদ্বোধন। তাদের এই ভাববাদের স্তর এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, "কেমন আছেন?" এই সরল প্রশ্নের উত্তরে তারা বলতোঃ

MA SHI TSAM LAH      >>     JUST BARELY NOT DEAD

তিব্বতে বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার হয়েছে দুই ধাপে। প্রথম ধাপে কিছু মঠ স্থাপিত হলেও দুশো বছর পড়ে আবার অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনা যেতে থাকে। এই ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ সজ্জা ছিল দেড়শ বছরের মতো। সোংসেন গামবো সপ্তম শতাব্দীতে প্রথম ধাপে কিছুটা সফল হলেও দ্বিতীয় ধারার স্ফুরণের পর আর কোন কারণে আটকায় নি। সেই ১০ম শতাব্দীর শেষ দিকে। তিব্বতের মানুষই যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্ষমতার টানাটানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে ও ধীরে ধীরে শুরু হয় বজ্রযানের ব্যাপক উত্থান। সেই ন্যিংমা থেকে শুরু করে একে একে গেলুগ পর্যন্ত। যা এখনো চলছে। এমনকি এখনো নিত্য নতুন শাখার তৈরি হচ্ছে। বিনয়ের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকার ফলে বৌদ্ধ মতবাদে অনেকগুলো শাখা দেখতে পাওয়া যায়। 

দালাই লামাঃ

জে সংখাপা পুনর্জন্মের পক্ষপাতী ছিলেন না বলেই জানা যায়। তাঁর প্রধান শিষ্যরা দিকে দিকে গেলুগ মতবাদের শিক্ষা প্রচার করতে থাকে। গেদুন দ্রোপা ও খেদ্রুপ জে এই সময়ে প্রধান ছিলেন। দ্রোপার মৃত্যুর পর কারমাপার মতো এক বিস্ময়বালকের জন্ম হয়। গেন্দুন গ্যিয়াৎসু। তিনি পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করে সবার মধ্যে সাড়া ফেলে দেন। তাঁকে দ্বিতীয় দালাই লামা ধরা হয়। কিন্তু সেই সময়ে দালাই লামা বলা হতো না গেলুগ ধারার প্রধানকে। তৃতীয় হিসেবে যাকে ধরা হয়, সেই সোনাম গ্যিয়াৎসুকে এই উপাধি দেয়া হয়। আর সেটি করেন মোঙ্গোলদের একটি অংশের খান,আলতান খান। ষোড়শ শতকে তিনি তিব্বতি গেলুগ শাখার প্রতির আকৃষ্ট হয়ে সোনাম গ্যিয়াৎসুকে মঙ্গোলিয়ায় আমন্ত্রন জানান। সেখানে তিনি নিজেকে শাক্য পণ্ডিত ফাগপার পুনর্জন্ম হিসেবে দাবি করেন। আগেও বলা হয়েছে, এই ফাগপাই কুবলাই খানকে বজ্রযান বৌদ্ধ মতবাদে দীক্ষা দেন। ফলে, কুবলাই খানের বংশধর হিসেবে আলতান এতে প্রভাবিত হোন এবং গেলুগ মতবাদ গ্রহন করে নেন। যার ফল হিসেবে এখনো মঙ্গোলিয়ায় এই ধারার প্রভাব বেশি দেখা যায়। সোনাম গ্যিয়াৎসুকে তিনি উপাধি দেন দালাই লামা। দালাই হলো মঙ্গোলীয় ভাষায় সমুদ্র। দালাই শব্দটা আসলে তিব্বতের গ্যিয়াৎসু শব্দের মঙ্গোলীয় সংস্করণ। সেই থেকে দালাই লামা নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, তৃতীয় দালাই লামা আর তিব্বতে ফেরেননি এবং চতুর্থ দালাই লাম হিসেবে নির্বাচিত হন আলতান খানের নাতি।

এই জন্মান্তরের ধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো পাঞ্চেন লামা। ইনি গেলুগ ধারার এক অন্যতম ধর্ম গুরু। এবং তাঁর প্রধান একটি কাজ হলো, পরবর্তী দালাই লামাকে খুঁজে বের করা। এবং দালাই লামাই পরবর্তী পাঞ্চেন লামাকে খুঁজে বের করেন। ৫ম দালাই লামা এই গেলুগ ধারার অভূতপূর্ব সংস্কার করেন এবং এই পরস্পর নির্ভরশীল দায়িত্বের শুরু করেন। তিনি ১ম পাঞ্চেন লামা হিসেবে খেদ্রুপ জেকে স্বীকার করে নেন। আবার তিনিই প্রথম দালাই লামা যিনি সমগ্র তিব্বতের উপর আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক - উভয় ক্ষমতার অধিকারী হন। এখানে একটি ছোট সংঘাতের কাহিনী আছে। ষোড়শ শতকে তিব্বতে গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। কাগ্যু ও গেলুগ ধারার লামাদের সাথে জড়িত হয়েই বিভিন্ন অভিজাত পরিবার তিব্বতের শাসনকাজ চালাতো। তো এই গৃহযুদ্ধে গেলুগদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন মঙ্গোল খান, গুশি খান। তিনি কাগ্যু ধারার শাসককে পরাজিত করেন ও ৫ম দালাই লামাকে পুরো তিব্বতের দায়িত্ব দেন। সালটা ১৬৩৭। এজন্য লোবসাং গ্যিয়াৎসুকে শুধু 'মহান পঞ্চম' বলেও ডাকা হয়। এরপর থেকে মোটামুটি দালাই লামাদের নির্বিঘ্ন সময় কাটতে থাকে। যদিও মাঝে তিব্বতের ক্ষমতা পুরোপুরি লামাদের হাতে ছিল। কিন্তু বড়সড় ঝামেলা বাঁধে কমিউনিস্ট চীনে এসে। 

মিং ও কিং সাম্রাজ্যের সময়ে মোটামুটি শান্তি ছিল। যদিও ব্রিটিশ আক্রমণের জন্য ও চীনের কিং সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী সুশির (Cixi) সময়ে ত্রয়োদশ দালাই লামাকে বেশ কিছু বছর ছন্নছাড়া থাকা লাগে। কিন্তু সুশি মারা যাবার পর সান ইয়াৎ সেনের সময়ে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। এবং ত্রয়োদশই তিব্বতের জাতীয় পতাকার নকশা করেন ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু লিন সেনের (কুয়োমিন্তাং চীনের চেয়ারম্যান) সময়ে এই ত্রয়োদশ দালাই লামা একটি অদ্ভুৎ কাজ করেন এই সময়ে। তিনি বলেন, সামনে তিব্বতের গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। তা মোকাবেলা করতে তাঁর দেহত্যাগ করে নতুন দেহে, যুবক শরীরে ফিরে আসতে হবে। তাই তিনি স্বেচ্ছায় যোগবলে মৃত্যুবরণ করেন এবং এর দু বছর পরেই উত্তর পূর্ব তিব্বতে জন্ম হয় তেনজিন গ্যিয়াৎসুর। চতুর্দশ দালাই লামা।

প্রফেসর থারম্যন বলেন, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তাঁকে দালাই লামার দায়িত্ব নিতে হয়। ত্রিশের দশকেই চীনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। চিয়াংকাইশেকের কুয়োমিন্তাং পার্টি ও মাও যেদোংএর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ যুদ্ধ আরো বেগবান হয় এবং ১৯৪৯ সালে শেষ পর্যন্ত মাও জয়ী হয়। আর কাইশেক কেবল ফরমোসা দ্বীপ বা তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যান। কিন্তু চীনের মূল ভূখণ্ডে মাও শুরু করে দেন শ্রেণী বিপ্লব। রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের দ্বারা তৈরি হওয়া অভিজাত শ্রেণীদের হটিয়ে সর্বহারা বা প্রোলেটারিয়েটদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সারা দেশ জুড়ে তুলকালাম শুরু হয়। তিব্বতকে সামলানোর দায়িত্ব দেয়া হয় দাং শাওপিংকে। যিনি পরবর্তীতে মাওয়ের সমাজতন্ত্রকে একটু বদলে নিয়ে বর্তমান আধুনিক চীনের অগ্রযাত্রার গোড়াপত্তন করেন। এই দাং তিব্বতে কঠোর হাতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেন। কৃষি ও পশুপালনভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় এমনিতেই খুব বড়সড় শ্রেণীবিভাগ ছিল না। তারপরও দাং কিছুটা জোর করেই লাসার অভিজাত কিছু পরিবারকে হেনস্থা করেন। আর সেই সময়ে দালাই লামা ১৫ বছর বয়সে সমগ্র তিব্বতের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনের সাথে তিব্বতকে একীভূত করতে পূর্ব চীনে ঘুরে বেড়ান। এ সময়ে তিনি মাওসহ চৌ এনলাই, শি ঝোংশুনের (বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিনপিংএর পিতা) সাথে কাছ থেকে মেশার সুযোগ পান। এবং ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি চীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহরে ঘুরেন। কিন্তু তিব্বতের মধ্যেই অনেকগুলো দল চীনের কমিউনিস্ট দখলের বিপক্ষে লড়ে যাচ্ছিল। আর সেই সূত্র ধরে ১৯৫৯ সালে চীনের সামরিক বাহিনী গান্দেন ফোদরাং বা গেলুগ ধারার কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেয়। আর সেই সময়েই তেনজিন সিক্কিম হয়ে ভারতের ধর্মশালায় আশ্রয় নেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এ সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি তেনজিনকে আশ্রয় দিলেও তিব্বতকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। আসলে অধিকাংশ দেশই দেয় নি। ফলে বিশ্বে তিব্বতের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্বশাসন কোনটির দাবীই জোরালো হয়নি। উলটো সত্তরের দশকে তাইওয়ানের বদলে কমিউনিস্ট চীন পুরো বিশ্বে সত্যিকারের চীনের স্বীকৃতি পায়। ইউএসএ কোল্ড ওয়ারের সময়ে চীনের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে তিব্বতে প্রচুর আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে তেনজিন পৃথিবীর নানা প্রান্তে সফর করে বৌদ্ধ মতবাদ ও তিব্বতের দাবি নিয়ে বহু সম্মেলন ও সাক্ষাৎকার দেন। ফলে তিনি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

পাঞ্চেন লামাকে একটি সমস্যা হয়। ১৯৯৫ সালে তেনজিন একজন পাঞ্চেন লামা নির্বাচিত করলেও চীন কর্তৃপক্ষ তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এবং সে জায়গায় সরকার মনোনীত একজনকে পরবর্তী দালাই লামা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে আত্মপ্রকাশ করায়। এখনো চীন সরকারের সাথে দালাই লামার তিব্বতি আন্দোলন চলমান।

তেনজিন গ্যিয়াৎসুর নিজের ভাষায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য তিনটি
১। মানবিক মূল্যবোধ। বিশ্ব মানবতার ধর্ম হলো উদারতা। সহমর্মিতা এবং সংযম। এ গুণগুলোর চর্চা যেন সকল মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই প্রস্ফুটিত হয়।
২। পরমতসহিষ্ণুতা। বিশেষত অন্যের ধর্ম নিয়ে সহনশীলতা। আর এর জন্য দরকার সঠিক জ্ঞানার্জন। প্রকৃত ও সঠিক পথে বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যেন আরো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন হয়। 
৩। তিব্বতের স্বায়ত্বশাসন। চীনে যে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছে তাতে চীনের নাগরিকদেরও বিশেষ করে তিব্বতিদের যোগদান করা উচিৎ। চীনের তাই তার নিজের জনগণের উপর ভরসা রাখা উচিৎ। ফলে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার মাধ্যমে তিব্বতিরা আরো স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কর্মযজ্ঞে শামিল হতে পারবে। নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের বাদ না দিয়ে সবাইকে নিয়ে চীনের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের গল্প লেখা উচিৎ। সেই স্বপ্নই দেখেন দালাই লামা।

আর দালাই লামার এই স্বপ্ন দেখার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আছে ৪টি আশার কথা। ৪টি পর্যবেক্ষণঃ-

১। শান্তির বিস্তারঃ ১০০ বছর আগেও মানে ১৯০০ সালের দিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিত্যকার ঘটনা। বড় বড় দেশগুলো কারো না কারো সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। শান্তির সময় ছিল শুধুমাত্র দুই যুদ্ধের মধ্যকার সময়। আর এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ শান্তির গুরুত্ব নিয়ে আরো সচেতন হয়েছে। অনর্থক যুদ্ধ-সংঘাতে জড়াচ্ছে না দেশগুলো। পুরোপুরি যুদ্ধ উবে না গেলেও একশ বছরের বিবেচনায় অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে তা স্বীকার করে নিতেই হবে।

২। ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচেষ্টাঃ সেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও মানুষ বিরাট বিরাট চিন্তাধারা বা মতবাদের উপর ভরসা করতো যে এগুলো তাদের জীবনের যাবতীয় সমস্যা দূর করে দিবে। ধর্ম, রাজনৈতিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পদ্ধতি - এসবের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সাধারণের সকল অসুবিধা হটিয়ে শান্তির পৃথিবী তৈরি করবে। কিন্তু এই একশ বছরে মানুষের এই ধারণা বদলেছে। এখন মানুষ অন্তত এইটুকু বুঝে যে, এসবের পরেও সবারই নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব আছে। এগুলোকে ভুলে গেলে হবে না। নিজের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

৩। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতাঃ ১৯০০ সালেও পৃথিবীর মানুষ পরিবেশ নিয়ে একদম সচেতন ছিল না। ময়লা-আবর্জনা বা শিল্প বর্জ্য যেখানে সেখানে তারা ফেলতো। তাদের ধারণা ছিল, পৃথিবী নিজ থেকেই নিজেকে পরিষ্কার করে নেবে। কিন্তু এখন মানুষ বুঝেছে, এত ব্যাপক হারে দূষণ চলতে থাকলে কেবল প্রকৃতির একার পুরোপুরি শুদ্ধিকরণ সম্ভব নয়। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। যা তারা এখন আগের থেকে অনেক ভালভাবে করছেও।

৪। শিক্ষার গুরুত্বঃ ১০০ বছর আগে মানুষ ভাবতো, যেকোন বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ দুঃখ-জরা, মৃত্যু বা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে তারা। নিত্য নতুন প্রযুক্তি আসবে এবং মানুষের একেকটি করে সমস্যা চলে যাবে। তাদের নিজেদের থেকে কিছু জানার বা করার দরকার নেই। এখন তা বদলে গেছে অনেকখানিই। তারা এখন শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে যথাযথভাবে ওয়াকিবহাল। ফলে উদারতা ও সংযমের ক্ষেত্রে তাদের মনোযোগ বেড়েছে। 

এই চার নম্বর আশার ক্ষেত্রে হালকা দ্বিমত আছে আমার, বলা যায়। এই তুলনাটি খুব সম্ভবত ইন্টারনেট যুগের বিস্ফোরণের আগে করা হয়েছে। এখন মানুষ আরো বেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোন জ্ঞানার্জন বা সহিষ্ণুতার দিকে মানুষের আগ্রহ হারাচ্ছে। নতুন কিছু শিখার আগ্রহ যেমন কমে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে, তেমনি সহনশীলতার দুয়ার ক্রমশ ছোট হচ্ছে। তবে অবশ্যই এটা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

আমরাও আশাবাদী হতে চাই। সামনের সময় আরো শান্তির হবে, মানুষের মাঝে হিংসা-লোভের উপশম হবে, বৃথা হয়রানি থেকে মানুষ মুক্তি হবে, একজনের সাথে আরেকজন অর্থ, জাতি বা স্বার্থের বদলে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বাঁধনে যুক্ত হবে। আমাদের কৃত কাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যাতে সমস্যা না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিৎ। কেননা আমরা সেই সময়ে জীবিত থাকবো না - এই ধরণের চিন্তা খুবই সংকীর্ণমননের পরিচায়ক। আমাদের কুশলী জীবনযাপন করতে হবে। 

এই যে এত বাক্যব্যয় করলাম, নানা পদের তথ্য-দর্শনের কচকচি কপচিয়েছি, এর থেকে মোটেও এটা প্রতীয়মান হয় না যে আমি এই বিষয়ে বিদ্বান বা পণ্ডিত কেউ। যৎসামান্য কিছু পড়েছি, ভিডিও দেখেছি। তা থেকে নিজের জন্য নোট নিতে নিতে ভাবলাম একটা মোটামুটি লেখা দাঁড় করানো যায়। অন্তত সংগ্রহে থাকবে। বেশিরভাগ জিনিসই উপযুক্ত উৎস থেকে নেয়া। কিন্তু বৌদ্ধ দর্শনের মতো এতো পুরনো আর এরকম বিশাল একটা জিনিস নিয়ে সম্পূর্ণ জানাটা প্রায় অসম্ভব দু-আড়াই মাসের অল্প সময়ে। তার উপর এতো এতো শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে এই মতবাদ যে সকল ধারা সম্পর্কে একদম সঠিক ধারণা নেয়া বেশ কঠিন। ফলে, ভুলত্রুটি বা বেঠিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে এবং চোখে পড়লে অবশ্যই ধরিয়ে দেবেন। আর এতোবড় একটা কিছু নিয়ে অল্প কিছু লেখার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছি তাঁর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। 

ཨྃ མ ཎི པདྨེ ཧཱུྃ 

ॐ मणि पद्मे हूँ 



লেখাটি কোন ধর্মমত প্রচার বা সমালোচনার উদ্দেশ্যে লিখিত নয়। সাধারণ জিজ্ঞাসা এবং কৌতূহল নিবারণের জন্য এটি একটি সামান্য প্রয়াসমাত্র।


কৃতজ্ঞতাঃ


১। রবার্ট থারম্যানের (কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধধর্মতত্ত্বের জে সংখাপা অধ্যাপক, পদ্মশ্রী ২০২০) লেকচার, Columbia University Course on Buddhism on edX
২। Indian Buddhism: A.K. Warder
৩। Tibetan Buddhism: John Powers
৪। Comparative History Of Civilizations In Asia (Volume 1): Edward L. Farmer
৫। উইকিপিডিয়া (অশোকস্তম্ভ ও নানা সংস্কৃতজাত বাণী )
৬। Ancient History Encyclopedia (ancient.eu)
৭। Lexilogos
* মতভেদ আছে

Comments

  1. প্রায় পুরো লেখাটা পড়লাম, ফয়সাল ভাই। আরো কয়েকবার রিভাইস দেওয়া লাগবে। অসম্ভব ভালো লিখেছেন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। কিছু পরিবর্তন বা পরিমার্জনের থাকলে অবশ্যই জানাবে।
      আশিস নিরন্তর।

      Delete
  2. খুব ভাল লাগল। তথাগত আপনাকে ভাল রাখুন।

    ReplyDelete

Post a Comment