শৈশব
ম্যাক্স ম্যুলারের একটি উক্তি দেখে বেশ কিছু প্রশ্ন এলো মাথায়। ভাবলাম লিখে রাখি। উক্তিটি হলঃ
Childhood has its secrets and its mysteries; but who can tell or who can explain them!
সত্যিকার অর্থেই। শৈশব কালে ভাষার উপর ভাল দখল থাকে না। ফলে অনেক অনুভূতি, অনেক কথা, অনেক আনন্দ, অনেক ব্যথা না বলাই থেকে যায়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে (প্রায় সব) যখন প্রকাশ করার সুযোগ আসে তখন আর মনেই থাকে না।
একদম শিশুর সাথে কথা বলার সময় বড়রা যেরকম আদুরে ভঙ্গিতে 'উলিউলিউলি', 'কুচিকুচিকু' বা 'পাপাপাপাইইই', 'পমপমপম' জাতীয় শব্দ করে বিকট মুখভঙ্গি করে তাতে ওদের কি মনে হয়? এটা সে কি স্বাভাবিকভাবে নেয়? কেবল হাসি দিলেই কি সন্তুষ্টি বুঝায়?
পূর্ণ বাক্য বলা শুরু করার পর নিজের মাথা খাটিয়ে একেকটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করার পর যখন সে শ্রোতা খুঁজে, তখন আগ্রহী ও গুণমুগ্ধ মাকে পেলে তাঁর কিরকম লাগে। বা কাউকে না পেলে কেমন লাগে। বা কাউকে পেলো যে তাঁর এই প্রতিভাতে আপ্লুত হল না, তখন?
আবার নিজের হাতে প্রথমবারের মত খাবার তুলে নিয়ে খাবার সময় তাঁর অনুভূতি কেমন হয়? বিশ্বজয়ের থেকে কোন অংশে কম?
কিংবা এক শিশু যখন বিছানা থেকে নেমে প্রথমবারের মতো হেঁটে হেঁটে অজানার দেশে অভিযানে বের হয়। এবং মাকে খুঁজে বের করার সেই দুঃসাহসিক অভিযানে সফল হয় তখন কেমন লাগে তাঁর? আর কোথাও না পেলে কি মনে হয়? একগাল হাসি বা গলা চিরে চিৎকারে কি তাঁর সমস্ত আবেগের সঠিক প্রকাশ হয়?
সহজাত প্রবৃত্তি বাদে বাকি যে অভ্যাসগুলো তাঁকে করানো হয়, সেগুলো শিখার সময় তাঁর মাথায় কি চলে? সে কি এসব যথার্থ বলে মেনে নেয়? যদি মেনে নেয়ও তাহলে কি বলে নিজেকে বুঝায়? আর যদি না মানতে চায় কি যুক্তিতে সে তা না করে? স্বার্থপরতা - অনেকে এই উত্তর দিতে পারে। কিন্তু সেটা কি তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি? নাকি পার্থিব পরিবেশে শিখে নেয় সে?
শিশুকে প্রথমবারের মতো পাখি বা পশু দেখানো হলে সে ওকে কীভাবে দেখে? হ্যাঁ, পরিচয় করে দেয়ার সময় বড়রা তাঁকে ঐ পাখি/পশুর ডাকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু এর বাইরে কি সে ভাবে না? সে কি ওকে খাদ্য হিসেবে দেখে, নাকি খেলার সাথী হবার সম্ভাবনা যাচাই করে? নাকি তাঁর ক্ষতি করতে তেড়ে আসছে সেই কল্পনা করে? আবারো, এটা বড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়ার উপর নির্ভর করে। কিন্তু তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তা কি নেই?
শিশুর প্রথম ব্যথা লাগার অনুভূতির প্রকাশ কি কেবলি কান্না? পরিবারের কেউ যদি ব্যথা পাওয়ার কারণকে আঘাত করার শিক্ষা দেয় তবে কি সে প্রতিহিংসা শিখবে?
একটি শিশু মৃত্যুকে কীভাবে দেখে? তাঁর সামনে কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হয়ে পড়লে সে কী ভাবে? কাছের কারো ক্ষেত্রে ও দূরের কারো ক্ষেত্রে কি তাঁর চিন্তাধারা ভিন্ন হয়?
কারো যদি বর্ণমালা চিনতে ও এর ব্যবহার করতে কষ্ট হয় এক অক্ষর বছরের বয়সে সেগুলোকে সে কীভাবে দেখে? মুখস্ত সেই বয়সে করানো যায়, মাদ্রাসায় প্রচুর ছেলেপিলে হাফিজ হয়ে বের হয় অনেক কম বয়সে। তাঁদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাধারা থাকার কথা না। তারাই বা কীভাবে এই নতুন শিক্ষাকে গ্রহণ করে? আর যারা ব্যর্থ হয় তাঁদের মনে কি চলে?
মানুষের বাচ্চা খুব অদ্ভুতভাবে বিচিত্র পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। ফ্যাক্ট যেহেতু জানি না। বিশ্বাসই ভরসা।
মনুষ্যশাবককে দিয়ে সার্কাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ৪-৫ বছর বয়সে নিপুণ খেলা দেখানো যায়, নাচের দুরূহ মুদ্রা আত্মস্থ করানো যায়, বিশাল বিশাল সূত্র, অঙ্ক, শব্দের বানান শিখানো যায়। আবার চৌর্যবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, আলসেমি শিখালে সে এসবেও পারদর্শী হয়ে উঠে।
অদ্ভুত একটা সময়। অদ্ভুত কিছু অনুভূতি। কিন্তু বলার কেউ নেই।
আচ্ছা, পশু-পাখির শাবকদেরও কি একইরকম হওয়ার কথা না?
Madonna and Child with the Young St John the Baptist, 1664, Oil on canvas by Elisabetta Sirani [Source: The Florentine] |
Comments
Post a Comment