সুনীল সুনামের সুনামগঞ্জ

সাগর (সিলেটি ভাষায় হাওর), পাহাড়ের কোলে। বাঙালদেশে এই বিষয়টা দুর্লভ বললে অত্যুক্তি হয় না। নীল আর নীল। ছেয়ে আছে আকাশ জুড়ে। পানির ঢেউয়ে ঢেউয়ে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলোও যেন পাল্লা দিয়ে নীল হতে চায়। অদ্ভুত নীলের জগৎ এই হাওর এলাকা। এর সাথে পূর্ণিমা হলে তো পোয়াবারো। ২০২০ এর ৩০-৩১ অক্টোবর। কার্তিকের মধ্যম ভাগ। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য যতটা চোখের আরাম, স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য ঠিক ততটাই খাটনির। 

ছিমছাম ট্রলারকে হাউজবোটের মত করে সাজিয়ে পর্যটনটাকে কিছুটা জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। তাহিরপুর থেকে নৌকাতে চড়ে প্রথমেই খাল বেয়ে চলে আসে হাওরে। বিস্তৃত এলাকাতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়ে আছে গামলার মতো গর্ত। ফলে বর্ষার মৌসুমে পাহাড় চুইয়ে আসা নদী-ঝিরির পানি জমে হয়ে যায় সাগরের মতো। পুরো আমনের সময়টা বিস্তর মাঠ থাকে পানির নিচে। পানি নামতে নামতে কার্তিক-অঘ্রান। এই সময়টাতে তাই পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাগরের মতো অবস্থা তৈরি হয়। আর এটাই হয়ে যায় মূল আকর্ষণ। 

টেকেরঘাট যাবার পথে নৌকার ছাদ থেকে [অক্টোবর ৩০, ২০২০]

একদিকে সুদূর দিগন্তে পাহাড়। ছোট ছোট মেঘালয়ের খাসি হিলস। আর দুদিকে চোখের সীমানাজুড়ে পুরোটা পানি। শুধু পানি। মন্থর গতির নৌকাগুলোতে করে চলে যেতে হয় টেকেরঘাটে। সেটাও প্রায় দু ঘণ্টার ধাক্কা। কিন্তু এই রাস্তাটাই সত্যিকারের আনন্দের। এতো নীল একসাথে কেবল সাগরেই পাওয়া যায়। স্থলের মধ্যে এহেন অদ্ভুত বৈচিত্র্য! অসাধারণ বললে বিষয়টার অবমূল্যায়ন হয়। 

যাওয়ার পথেই গুচ্ছ গুচ্ছ দ্বীপের মতো গ্রামগুলো ভেসে থাকে। হাওরের মাঝে অল্প কিছু উঁচু জায়গা থাকাতে সেখানেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। ঘরগুলো একেবারে গা ঘেঁষে ঘেঁষে উঠানো এবং যৌক্তিকভাবেই এই কয়ঘরের বাসিন্দাদের আদিপুরুষ একই। রাস্তা বলতে কিছু নেই ভরা মৌসুমে। উঠানেই হাওর। আর প্রতিটা গ্রামের সাথেই থাকে নৌকা বাঁধা। প্রতি গ্রামে সাধারণত একটি করে টিউবওয়েল। কিছু জায়গায় তাও নেই। মানুষগুলোর আয়ের উৎস শুকনো মৌসুমে চাষবাস আর ভরা সময়ে টুকটাক পর্যটনের চেষ্টা। যেটাতে এখনো বহুদূর যাওয়া বাকি। সেচ ব্যবস্থা থাকলে ধান হয়, হয় ক্ষীরা। আর সাথে প্রতি বাড়িতেই হাঁস পালার ঝোঁকটা চোখে পড়ে ভালমতোই। গেরস্থ বাড়িতে গরু রাখাটা যেন একটু বিলাসিতা। মাছ মারার হিড়িক আছে কিন্তু এতোটা রপ্তানিকেন্দ্রিক যে নিজেদের পাতে তোলার মতো মাছের ব্যবস্থাটা কিছু কম বলে মনে হয়। ঘরের খবর কয়জনই আর হাটে বাজারে বলে বেড়ায়!

দ্বীপের মতো গ্রাম। শুকনা মৌসুমে সামনে যদিও রাস্তা থাকে। এখন তা পানির নিচে। সামনে বাড়ির বাচ্চারা গোসল সেরে নিচ্ছে। [অক্টোবর ৩০, ২০২০]

ডিজেল ইঞ্জিনের মৃদু ভটভট আওয়াজের মাঝে হালকা দুলুনি খেতে খেতে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য আর অনুভূতি, সেটা কেবল দশ বারো বাক্যে বুঝানো মহৎ স্রষ্টার কাজ। এতো নীল, এতো মিষ্টি বাতাস, এতো মনোরম গন্ধ। প্রকৃতির খেয়াল নিয়ে ভাবতে গেলে তখন অবাক হয়ে যেতে হয়। সবুজের চিকন রেখার উপর আর নিচে সুনীল চাদর। কিন্তু চাদরটার বিস্তারটাই অবাক করা। এক মানুষের চোখের ক্ষমতা নেই পুরো ক্যানভাসটাকে একসাথে মগজে ঢোকানোর। এখানেই আমাদের ক্ষুদ্রতা। বিশাল-মহান সৃষ্টির সামনে আমাদের জায়গা অতটুকুই, যতটুকু আমরা পিঁপড়াদের গণ্ডিকে মনে করি। সন্ধ্যাটা নেমে গেলেই দেখা যায় ভিন্ন রকম শান্তির রূপ। নৌকা নিয়ে মাঝ-হাওরে নোঙর ফেলে দিলেই চেপে ধরে বসে এক আলোকিত আঁধার। জ্যোৎস্নার আলো সব কিছু ছাপিয়ে উঠে। ঠাণ্ডা-শান্ত আলোর বন্যায় হেঁড়ে গলায় গান জুড়লে আকাশ-বাতাস যেন নিন্দা করতে ভুলে যায়। প্রকৃতি তাঁর নিজের কোলে নিয়ে নেয় তালছাড়া সুর, মাথাহীন কথা আর সম্বিৎ ছাড়া আবেশ। নিঃসীম আকাশ ও অবারিত পানির মাঝে সব দুশ্চিন্তা, কামনা, বাসনা, সুচিন্তা, ভাবনা উবে যায় জাদুকরের হাতে রাবার বলের মতো। ঠিক যেমন পূর্ণ জ্যোৎস্না শুষে নেয় বিজলিছাড়া গ্রামান্তরের জট পাকানো অন্ধকার। আর এর মাঝেই উত্তর কোনায় মেঘ জমে উঠলে আসন্ন ঝড়ের ভয়ে গলা শুকিয়েও আসে। 

ঢেউয়ের ধাক্কায় একটু একটু করে নৌকা এদিক ওদিক দুলে। পাহাড় আর পানি ছুঁয়ে আসা বাতাস হালকা ঠাণ্ডার ঝাপটা দেয়। করচ আর হিজলের সারি পাহারা দেয় শহর পালানো কিছু যুবকদের। চাঁদটা আকাশের ডিমলাইট হয়ে জেগে থাকে সারারাত। 

জাদুকাটার উপর বারিক্কা টিলা থেকে। দূরের পাহাড় ভারতের। [অক্টোবর ৩০, ২০২০]


জাদুকাটার প্যানোরোমা [অক্টোবর ৩০, ২০২০]

টেকেরঘাটে পাথর কাটার ক্যোয়েরি ছিল একসময়। রেললাইনও বসানো ছিল। পাহাড়ের পায়ে পাথর কাটতে কাটতে হয়ে গেছে শ-দুশ ফিট গর্ত। পানি ভরে হয়ে গেছে দীঘি। নিলাদ্রি লেক। এক মানুষ নিচে পা পৌঁছাতে পারলে ঠাণ্ডা পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গোসল বা জলকেলি যেটাই করতে চাওয়া হোক, এখানে খারাপ হয় না। আর বাইক ভাড়া করে চলে যাওয়া যায় জাদুকাটা নদীর 'টপভিউ' নিতে। বারিক্কার টিলার থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ে আশ্চর্য সুন্দর আর শান্ত এই পাহাড়ি নদী। পাহাড় থেকে টুপ করে নেমে এসে বাংলাদেশে ঢুকেছে জাদুকাটা। নামটা যতটা সুন্দর, চেহারা তার পুরোপুরি মান হয়তো ভরা বর্ষায় রাখতে পারে। প্রায় শুকনো সময় হওয়াতে কিছুটা প্রাণহীন লাগলে দর্শকের সৌন্দর্য বিবেচনা প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। আছে পাশেই শিমুল বাগান। সারে সারে শিমুলের গাছ ফাল্গুনের চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের ট্রেইলারই দেখাতে পারে। এই সময়ে লাল ফুলের পরিবর্তে ঘন সবুজের ছাতাই সই। নেহায়েত কম বড় না এই বাগান।

জাদুকাটা নদীর পারে বিশাল জায়গা নিয়ে শিমুলের বাগান। সবুজ দাঁড়ায়ে গাছ কাতারে কাতার। [অক্টোবর ৩০, ২০২০]

সহিস এসে জিজ্ঞেস করে, "গুরায় চইরা গুরবায় না?" এ ডাকে সাড়া দেয়াটাই সমীচীন মনে হয়েছিল। প্রথম ঘোড়ায় চড়া। ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক থাকলেও শান্ত-সৌম্য ঘোড়ার লক্ষ্মীপনায় সেটা চলে গিয়েছিল। এক মিনিটের ছোট্ট 'গুরা' করে এসে নিজেকে নাইট মনে না হলেও শিভালের উপর আলাদা এক সম্মান এসে পড়ে। সহিস ভাইসাহেবেরও সাহস আছে। আনাড়ি এক সওয়ারকে নিয়ে কিছুক্ষণ লাগাম ধরে ধরে আগালেও শেষ মুহূর্তে দিলেন সেটা ছেড়ে। দৌড় লাগালে হয়তো এক শিমুলের ডাল ধরে ঝুলে পড়তাম। অজানা হাড়গোড় ভাঙার চেয়ে নিশ্চিতভাবে হাতের তালু ঝাঁঝরা করা উত্তম। 

সন্ধ্যের সময়টা লাকমাছরার পারে কাটানো অন্য আরেক মোহ। পাহাড়ের তলা দিয়ে সারি সারি ল্যাম্পপোস্ট আর কাঁটাতারের বেড়া। এরই মাঝ দিয়ে ছোট্ট এক ধারা হয়ে নেমে আসছে ঝিরির প্রবাহ। কলকল ধ্বনি আর ঘাসের গন্ধে ভেজা বাতাসে সূর্যাস্ত আর চন্দ্রোদয়। মায়াঘেরা পরিবেশে একইসাথে জন্ম আর মৃত্যু দেখা। নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা পানিতে পা ভেজাতে মন আনচান করতেই পারে। 

"বাই, ইদিখে খাইস্যাদের আয় পাহাড় তেখে বেশি"। মাঝির সাথে কথা বললে অনেক না দেখা জিনিস চোখে ভাসিয়ে তোলা সম্ভব হয়। মেঘালয়ের খাসিয়া জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশে বাজারে কেনা-বেচা করতে এলে অনেক সময়ই ভারতের চেয়ে বেশি লাভ করে বাড়ি ফেরে বলেই আনাস ভাইয়ের ধারণা। তার থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। জীবনধারণের সংগ্রাম। গ্রামের রাজনীতি। সীমান্তের এপারওপার সম্পর্ক। এনজিও ও সাধারণ দাতাগোষ্ঠীদের নিয়ে মানুষের চিন্তাধারা। ধর্ম-দর্শন। গ্রামীণ কোন এক বীরত্বের কাহিনী। অতি অল্পে তুষ্টি। আর সব বাধাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সবসময় একটা আনন্দের হাসি। বছরের এক মৌসুমে তাই নিয়মিত খাবার না জুটলে, পানি নেমে গেলে জায়গা-জমিতে নিজের হক না পেলে, দুদিন পরপর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়াতে ফসল নষ্ট হলে, ছয়মাস পর পর বাড়ি ফেরার রাস্তা হাওয়া হয়ে গেলে, মহামারির জন্য বাৎসরিক ভারত ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেলে, রাজধানীর নীতি-নির্ধারকদের খেয়ালে বাজার-সদাই বাধাপ্রাপ্ত হলে, আবার প্রকৃতির খেয়ালে হুটহাট ঝড়ে নৌকা উল্টে গেলে, যাকাত বা দয়াদাক্ষিণ্যের সময় সিলেট বা সুনামগঞ্জের ধনী মানুষদের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো লাগলে, অদৃষ্টবাদে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করলে, এবং কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের মিষ্টি কথায় ভুলে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও তারা হাসিটা হারায় না। দিনশেষে তাই দেনা-পাওনার হিসেবে মানুষের কাছে দেনা বেশি থাকলেও এক অদৃশ্য শক্তির কাছে পাওনার খাতাটাকে লম্বা ভেবে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। পরের দিন নতুন এক সকালে নতুন কোন যুদ্ধে নামবে বলে। জীবন এখানে পেশির দামে কেনা।

জায়গার সাথে সঙ্গীরাও গুরুত্বপূর্ণ। এতো এতো ব্যাংক ও 'প্রায় ব্যাংক'এর কর্মকর্তা আর উদ্যোক্তাদের সাথে (ব্যবসা বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসনিবাসী) কিছু স্মৃতি তৈরি-এটিও এক অর্জন। দুদিন মিলিয়ে তিন-চার ঘণ্টার ঘুম, ছায়াছাড়া ন্যাংটো রোদে কালো চামড়া জলপাই রঙের করে আর মুদ্রাথলের বারোটা বাজিয়ে যেই অভিজ্ঞতা আসে-সেটা অন্য কিছু দিয়ে পুষিয়ে দেয়া সম্ভব না। 

সিলেটের চা বাগানে জেদের বশে বৃষ্টিতে ভিজার বিষয়টা সহজে ভুলার না। চা বাগানের গভীরে গেলে পানির ধারা বাড়ে, বের হয়ে আসতে থাকলে কমে-এর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। মিশমিশে অন্ধকারে মনের আন্দাজে ও পায়ের উপর বিশ্বাস রেখে পাকা রাস্তার সন্ধানের যে রোমাঞ্চ তার তুলনা হয় দশ মিনিটে চায়ের দোকানের যাওয়ার আশায় আধা ঘণ্টা হেঁটে তার দরজা আবিষ্কার করাতে। দুটোই আবার পানির তোড়ে ভিজতে ভিজতে।

সিলেটে গেলে ছাতা বা বর্ষাতি ছাড়া যাওয়া গর্দভের কাজ- এই ভ্রমনের শিক্ষা।

হয়তো আবার হবে। 


"দূর্বার বনে বান ডেকেছে,

আকাশ জুড়ে ফুলের মেলা,

পাহাড় ঘুমায় চিৎ হয়ে এখানে,

মানুষ ভাসায় আশার ভেলা।

দিনের বেলায় নীলের জলসা

রাতে চলে রূপালী ভোজ,

জল-পাহাড়ের সঙ্গমে এসে

আমার মাঝে চলে 'আমি'র খোঁজ।"

 

নীল ছবি





Comments